আজ আমার বাংলাদেশ ছাড়ার ১৮ বছর পূর্ণ হল। বলা যায় আমার প্রবাস জীবন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেল।
১৯৯৬ সালের অগাস্ট মাসের পাঁচ তারিখ - সকালবেলাতে ফ্লাইট। যাচ্ছি আমেরিকা। দেশ কি জিনিস সেই বিষয়ে কোন ধারণা নেই, শুধু আছে, উত্তেজনা, শংকা আর কিছুটা দুঃখ। পার্থিব বলতে যা কিছু আছে সব কিছু এঁটে গেছে দুটো সুটকেসে - বঙ্গবাজারের কাপড়-চোপড়, কিছু পড়ার বই, শামসুর রাহমান আর জীবনানন্দের দুটো কবিতার বই। কবিতার বইয়ের মার্কেট নিশ্চিতভাবেই কম, আর সব কিছু হারিয়ে ফেললে ওই দুটো কবিতার বই এখনও রয়ে গেছে।
এই আঠারো বছরে মার্কিনি হতে পারিনি, সেই চেষ্টাও কোনদিন করেছি বলে মনে হয় না। আর সেই সুযোগে আমার নিজের দেশটাও যেন হাফপ্যান্টের ছেঁড়া পকেটে রাখা মার্বেলের মতো গলে বের হয়ে গেল। দেশটা মাঝে মাঝে আমার দাড়িওয়ালা মধ্যবয়েসী বন্ধুদের মতো হঠাৎ হঠাৎ উদয় হয়। নিজের শহরটাও একদম অচেনা হয়ে গেছে।
‘মনে আছে কয়লার দোকানের পিছনে ছিল বড় উঠোন,
কয়েকটা আম কাঁঠাল গাছ, ভাঙা বারান্দা, ঘর দোর।
এখন তো কিছুই নেই,
শুধু একটা নেমপ্লেট, ‘নাগরিক’।
চারতলা বাড়ি, ষোলটা ফ্ল্যাট,
এরই মধ্যে কোনওটায় আমি ফিরে এসেছি।
কিন্তু কয়তলায়, কাদের ফ্ল্যাট?
স্বর্গীয় রূপকবাবুর পদবিটা যেন কী ছিল,
তাঁদের নতুন বাসাবাড়িতে এখন কে থাকে -
কোনও খোঁজখবর রাখি না,
শুধু মনে আছে তাঁর ভাইঝি টুলটুলি।
না। সেই বাড়িটা জগৎসংসারে আর নেই,
টুলটুলিকে কেউ চেনে না।
পুরনো শহরতলির নতুন পাড়ায় বোকার মতো ঘুরি।
(পুরনো শহরতলিতে/ তারাপদ রায়)
অথচ দেশ ছাড়ার দিনটা স্পষ্ট মনে আছে। মেঘলা, শ্রাবণ মাসের শেষ। সকালে ফ্লাইট ছিল - আমি ভোর রাতে উঠে বাসার সামনের পেয়ারা গাছটার নিচে দাঁড়ালাম। ওদের সাথে হয়তো অনেক অনেক দিন আর দেখা হবে না। আকাশটা মেঘলা, গুমোট একটা গরম। দুই তিন ফোঁটা বৃষ্টি পড়েই শেষ হয়ে গেল। বাংলাদেশে আমার সেই শেষ বর্ষাকাল দেখা। এর পর কল্পনা ছাড়া আর কোথাও দিনের পর দিন আকাশের চোখ থেকে অবিরল জল ঝরতে দেখিনি...বাংলাদেশের বর্ষা শুধু রয়ে গেছে শুকনো কবিতার বইয়ের পাতায়।
তারপর দিগন্তে বেদনা
ঘন চুল এলিয়ে জমাট,
ইলেকট্রিকের দীর্ঘ তারে হুহু কাক, জলকণা
কী ব্যাপক জাল; সারি সারি ঘরবাড়ি মাঠঘাট
জব্দ, বন্দী আকাশে মেঘের মোষ কিংবা, মেষ
মাঝে-মধ্যে বিদুৎরেখা, বইছে হাওয়ার
দীর্ঘশ্বাস শহরকে ঘিরে, রবীন্দ্র সঙ্গীত শেষ
ক্যাসেট প্লেয়ারে, বসে আছি একা ঘরে,
আকাশের চোখ ফেটে
ঝরে শুধু ঝরে
অশ্রুজল, ইচ্ছে নেই কোথাও যাওয়ার।
কেউ কি দাঁড়ালো এসে গেটে?
যূথীর বিধুর গন্ধে কী যেন হঠাৎ মনে পড়ে
হৃদয়ের ঘোর মন্বন্তরে।
(কবেকার হাহাকার/শামসুর রাহমান)
সেই দিন কি আমি চলে যাওয়ার পরে বৃষ্টি হয়েছিল, ঝমঝম করে? দুপুরে কি আম্মা শুয়ে শুয়ে সানন্দা পড়ছিলেন? বিকেলটা কি আলো আর ছায়াতে মিশে ছিল? আমার বন্ধুরা সেই সন্ধ্যাতে কি করেছিল?
আমাকে কি কেউ মনে করেছিল হৃদয়ের ঘোর মন্বন্তরে?
আমার ঘরটা নিশ্চয় রাতে অন্ধকার ছিল, সিগারেটের গন্ধ ছিল না ভিজে ভিজে হাওয়াতে।
কোন কিছুই আর জানা হয় নি।
ভোর শেষ হওয়ার আগেই ম্যাকডোনাল্ড ডগলাসের বিমানটা আমাকে নিয়ে চলে গেছে দূরে, বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করতে ওদের ৩০ মিনিটের বেশি লাগে না...
আমি সেই গতি পেলাম না, এক জীবনেও জন্মভূমি অতিক্রম করতে পারলাম না।
১৯৯৬ সালের অগাস্ট মাসের পাঁচ তারিখ - সকালবেলাতে ফ্লাইট। যাচ্ছি আমেরিকা। দেশ কি জিনিস সেই বিষয়ে কোন ধারণা নেই, শুধু আছে, উত্তেজনা, শংকা আর কিছুটা দুঃখ। পার্থিব বলতে যা কিছু আছে সব কিছু এঁটে গেছে দুটো সুটকেসে - বঙ্গবাজারের কাপড়-চোপড়, কিছু পড়ার বই, শামসুর রাহমান আর জীবনানন্দের দুটো কবিতার বই। কবিতার বইয়ের মার্কেট নিশ্চিতভাবেই কম, আর সব কিছু হারিয়ে ফেললে ওই দুটো কবিতার বই এখনও রয়ে গেছে।
এই আঠারো বছরে মার্কিনি হতে পারিনি, সেই চেষ্টাও কোনদিন করেছি বলে মনে হয় না। আর সেই সুযোগে আমার নিজের দেশটাও যেন হাফপ্যান্টের ছেঁড়া পকেটে রাখা মার্বেলের মতো গলে বের হয়ে গেল। দেশটা মাঝে মাঝে আমার দাড়িওয়ালা মধ্যবয়েসী বন্ধুদের মতো হঠাৎ হঠাৎ উদয় হয়। নিজের শহরটাও একদম অচেনা হয়ে গেছে।
‘মনে আছে কয়লার দোকানের পিছনে ছিল বড় উঠোন,
কয়েকটা আম কাঁঠাল গাছ, ভাঙা বারান্দা, ঘর দোর।
এখন তো কিছুই নেই,
শুধু একটা নেমপ্লেট, ‘নাগরিক’।
চারতলা বাড়ি, ষোলটা ফ্ল্যাট,
এরই মধ্যে কোনওটায় আমি ফিরে এসেছি।
কিন্তু কয়তলায়, কাদের ফ্ল্যাট?
স্বর্গীয় রূপকবাবুর পদবিটা যেন কী ছিল,
তাঁদের নতুন বাসাবাড়িতে এখন কে থাকে -
কোনও খোঁজখবর রাখি না,
শুধু মনে আছে তাঁর ভাইঝি টুলটুলি।
না। সেই বাড়িটা জগৎসংসারে আর নেই,
টুলটুলিকে কেউ চেনে না।
পুরনো শহরতলির নতুন পাড়ায় বোকার মতো ঘুরি।
(পুরনো শহরতলিতে/ তারাপদ রায়)
অথচ দেশ ছাড়ার দিনটা স্পষ্ট মনে আছে। মেঘলা, শ্রাবণ মাসের শেষ। সকালে ফ্লাইট ছিল - আমি ভোর রাতে উঠে বাসার সামনের পেয়ারা গাছটার নিচে দাঁড়ালাম। ওদের সাথে হয়তো অনেক অনেক দিন আর দেখা হবে না। আকাশটা মেঘলা, গুমোট একটা গরম। দুই তিন ফোঁটা বৃষ্টি পড়েই শেষ হয়ে গেল। বাংলাদেশে আমার সেই শেষ বর্ষাকাল দেখা। এর পর কল্পনা ছাড়া আর কোথাও দিনের পর দিন আকাশের চোখ থেকে অবিরল জল ঝরতে দেখিনি...বাংলাদেশের বর্ষা শুধু রয়ে গেছে শুকনো কবিতার বইয়ের পাতায়।
তারপর দিগন্তে বেদনা
ঘন চুল এলিয়ে জমাট,
ইলেকট্রিকের দীর্ঘ তারে হুহু কাক, জলকণা
কী ব্যাপক জাল; সারি সারি ঘরবাড়ি মাঠঘাট
জব্দ, বন্দী আকাশে মেঘের মোষ কিংবা, মেষ
মাঝে-মধ্যে বিদুৎরেখা, বইছে হাওয়ার
দীর্ঘশ্বাস শহরকে ঘিরে, রবীন্দ্র সঙ্গীত শেষ
ক্যাসেট প্লেয়ারে, বসে আছি একা ঘরে,
আকাশের চোখ ফেটে
ঝরে শুধু ঝরে
অশ্রুজল, ইচ্ছে নেই কোথাও যাওয়ার।
কেউ কি দাঁড়ালো এসে গেটে?
যূথীর বিধুর গন্ধে কী যেন হঠাৎ মনে পড়ে
হৃদয়ের ঘোর মন্বন্তরে।
(কবেকার হাহাকার/শামসুর রাহমান)
সেই দিন কি আমি চলে যাওয়ার পরে বৃষ্টি হয়েছিল, ঝমঝম করে? দুপুরে কি আম্মা শুয়ে শুয়ে সানন্দা পড়ছিলেন? বিকেলটা কি আলো আর ছায়াতে মিশে ছিল? আমার বন্ধুরা সেই সন্ধ্যাতে কি করেছিল?
আমাকে কি কেউ মনে করেছিল হৃদয়ের ঘোর মন্বন্তরে?
আমার ঘরটা নিশ্চয় রাতে অন্ধকার ছিল, সিগারেটের গন্ধ ছিল না ভিজে ভিজে হাওয়াতে।
কোন কিছুই আর জানা হয় নি।
ভোর শেষ হওয়ার আগেই ম্যাকডোনাল্ড ডগলাসের বিমানটা আমাকে নিয়ে চলে গেছে দূরে, বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করতে ওদের ৩০ মিনিটের বেশি লাগে না...
আমি সেই গতি পেলাম না, এক জীবনেও জন্মভূমি অতিক্রম করতে পারলাম না।