আমি তখন ক্লাস টু-তে পড়ি। আমাদের বাসার সামনে সাদা রঙের একটা গেট ছিল। যেটার উপরে চড়া যেত। মাটিতে লাথি মেরে ওটাতে চড়ে বসলে মনে হত জাহাজে চড়ে বসেছি। আমি প্রায় দুপুরেই জাহাজ চালাতাম। একদিন সেই কাজ করছিলাম, এই সময়ে এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রমহিলা এসে হাজির। পরনে নানের পোষাক। আমাকে খাঁটি বাংলাতে জিজ্ঞেস করলেন - তোমার মা বাসাতে আছে?
আমি জানলাম ভদ্রমহিলার নাম সিস্টার লিওনারা। উনি সম্ভবত হলিক্রস কলেজে কাজ করতেন। আমাদের পাড়াতেই স্কুলটা। আম্মার সাথে মিলে বই লিখবেন। সরকার তখন পুরনো পাঠ্যবই পরিবর্তন করে নতুন বই প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আম্মা ক্লাস থ্রি-এর ইংরেজি বই লিখবেন। বইয়ের নাম "ইংলিশ ফর টুডে"।
এই বই লেখাতে আমার একটা ছোট ভূমিকা ছিল। আম্মা বইটা লেখার সময় মাঝে মাঝে আমাকে পড়ে শুনাতেন, দেখতেন আমি বুঝতে পারছি কিনা। কেননা আমি এবং আমার সমবয়েসিরাই এই বইয়ের পাঠক হবে। আমাদের বইটা বুঝতে হবে।
এই লেখা থেকে মনে হতে পারে আমি ইংরেজিতে নিশ্চয় খুব ভালো ছিলাম। কথাটা পুরোপুরি ভুল। ক্লাস থ্রি-এর ইংরেজিতে পেয়েছিলাম ৩৬, যদিও আমার নিজের মা-ই সেই বইয়ের লেখক। আম্মা ক্লাস ফাইভের ইংরেজি বইয়ের অনেকটাই লিখেছিলেন, ওটাতেও আমার ফলাফল প্রায় কাছাকাছিই ছিল। এর পেছনে একটা কারন ছিল। আম্মার ধারণা ছিল বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে বেশি চাপাচাপি করতে হয় না। এতে পড়ার আগ্রহ নাকি কমে যেতে পারে। সুতরাং পড়ার আগ্রহ বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি পড়াশোনা থেকে অনেক দূরত্বে থাকতাম।
আম্মার দ্বিতীয় থিওরি ছিল যে - নিচু ক্লাসে পড়ার চাপ না থাকলে বড় হয়ে পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। এটার কিছু বাস্তব প্রমাণ আমি পেয়েছি। ক্লাস নাইন থেকে আমি পড়াতে মনোযোগী হই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ পর্যন্ত আমার আগ্রহ ছিল - দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পরে আমি আবার ক্লাস থ্রি মোডে চলে যাই। ইঞ্জিনিয়ারিং এর লেখাপড়া আমার অপছন্দ ছিল। এই শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পরও আমার কোন আগ্রহ জন্মে নি। এখনও নেই।
আম্মা অনেক পাঠ্যবই লিখেছেন। অনেক কারিকুলাম তৈরির কাজ করেছেন, স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষা দিয়েছেন, তাদের জন্য ম্যানুয়েল লিখেছেন। এই সবই ছিল তাঁর পেশাগত কাজ।
এর বাইরেও তাঁর অসাধারণ একটা দক্ষতা ছিল। তিনি ছিলেন অসামান্য গল্পকথক। তিনি মুখে মুখে গল্প বানিয়ে বলতেন। গল্পলেখক না বলে গল্পকথক বলতে হচ্ছে কেননা তিনি কোনদিন সেই সব মুখে মুখে বলা গল্প লেখার চেষ্টা করেন নি। বেশি লিখলে হাতে ব্যথা করে। অকাট্য যুক্তি।
আম্মা একটা গল্প বলেছিলেন যেটার নায়িকা ছিলেন তিনি নিজেই। তাঁর বাস ছিল পরীদের দেশে - সেখানে নানান ঘটনা ঘটে, শেষ পর্যন্ত তাঁকে সেই দেশ থেকে এই মানুষের পৃথিবীতে নির্বাসন নিতে হয়। পরীদের দেশের মেয়েদের পায়ের পাতা ছোট হয়, গল্পের শেষে তিনি প্রমাণ দিয়ে দেন যে তিনি আসলেই ওই দেশ থেকে এসেছেন। গল্পটা শুনে আমার খুবই দুঃখ হয়েছিল, মনে হয়েছিল, এতোসব গ্যাঞ্জাম না হলে আমিও ওই দেশে থাকতাম, এতো এতো পড়াশোনা করতে হতো না।
এই গল্পের একটা মারমেইড ভার্সান আমি আমার মেয়েকে শুনিয়েছি। সেইখানে আমিই নায়ক। আমাকে বাধ্য হয়ে মারমেইডদের দেশ ছাড়তে হয়, আমার নিবাস ছিল বেগুনবাড়ি খাল অর্থাৎ যেটার বর্তমান নাম হাতিরঝিল। এই গল্প শুনে আনুশারও খুব দুঃখ হয়েছিল, মারমেইডদের দেশ বাধ্য ছেড়ে আসাটা সম্পূর্ণ "নট ফেয়ার" একটা ঘটনা - কেননা আনুশার মারমেইড হওয়ার খুবই শখ।
ডিসেম্বর মাসে ডিজনি ওয়ার্ল্ডে গিয়েছিলাম। ছোটবড় সবারই হাঁ হয়ে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে সেইখানে। ওয়াল্ট ডিজনির কল্পনা ছিল সেই সাথে সাথে ব্যবসার বুদ্ধিও ছিল। এই দুইয়ের সংমিশ্রন সাধারণত পাওয়া যায় না, কল্পনাপ্রবণ মানুষেরা সাধারণত ব্যবসা ভালো বুঝে না। কিন্তু ওয়াল্ট ডিজনি বুঝতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান চাইলে যে কোন কিছু সম্ভব করতে পারে। ডিজনি চলচ্চিত্র দেখেও তা-ই মনে হয়।
কিন্তু কল্পনা করতে শেখাটাও একটা বড় গুণ, যেটা অর্জন করতে হয়। সেটা করতে গেলে প্রচুর বই পড়তে হয়, মাথার ভেতরে সিনেমা তৈরি করতে হয়, নিজেকেই সত্যজিৎ রায় হতে হয়। ডিজনির বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ ওইখানেই, ভদ্রলোকের প্রতিষ্ঠান শিশুদের জন্য কল্পনার রাজ্য তৈরি করে দিয়ে তাদের কল্পনার ধারটা সম্ভবত কমিয়ে দিচ্ছে। উনি তৈরি না করলে হয়ত প্রতিটি শিশুই নিজেরা একেকজন পিটার প্যান চলচ্চিত্র তৈরি করতো মাথার ভেতর।
আমার মা এই দেশে জন্ম নিলে অনায়াসে নাম করা শিশু সাহিত্যিক হতে পারতেন বলেই আমার মনে হয়। ডিজনিতে গিয়ে আমি বুঝলাম, ছোটবেলাতে মুগ্ধ হয়ে শোনা সেই সব গল্প আমার মনের কল্পনার রাজ্যের দরজাগুলো খুলে দিয়েছে, আমাকে চিন্তা করতে শিখেয়েছে, আমাকে ভাবিয়েছে। আমার নতুন করে উপলব্ধি হলো, সারা জীবনে একটি গল্পের বই না লিখেও আমার মা আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পকার - আমার দুঃসময় পাড়ি দেওয়ার জাহাজের রূপকার।
আমি জানলাম ভদ্রমহিলার নাম সিস্টার লিওনারা। উনি সম্ভবত হলিক্রস কলেজে কাজ করতেন। আমাদের পাড়াতেই স্কুলটা। আম্মার সাথে মিলে বই লিখবেন। সরকার তখন পুরনো পাঠ্যবই পরিবর্তন করে নতুন বই প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আম্মা ক্লাস থ্রি-এর ইংরেজি বই লিখবেন। বইয়ের নাম "ইংলিশ ফর টুডে"।
এই বই লেখাতে আমার একটা ছোট ভূমিকা ছিল। আম্মা বইটা লেখার সময় মাঝে মাঝে আমাকে পড়ে শুনাতেন, দেখতেন আমি বুঝতে পারছি কিনা। কেননা আমি এবং আমার সমবয়েসিরাই এই বইয়ের পাঠক হবে। আমাদের বইটা বুঝতে হবে।
এই লেখা থেকে মনে হতে পারে আমি ইংরেজিতে নিশ্চয় খুব ভালো ছিলাম। কথাটা পুরোপুরি ভুল। ক্লাস থ্রি-এর ইংরেজিতে পেয়েছিলাম ৩৬, যদিও আমার নিজের মা-ই সেই বইয়ের লেখক। আম্মা ক্লাস ফাইভের ইংরেজি বইয়ের অনেকটাই লিখেছিলেন, ওটাতেও আমার ফলাফল প্রায় কাছাকাছিই ছিল। এর পেছনে একটা কারন ছিল। আম্মার ধারণা ছিল বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে বেশি চাপাচাপি করতে হয় না। এতে পড়ার আগ্রহ নাকি কমে যেতে পারে। সুতরাং পড়ার আগ্রহ বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি পড়াশোনা থেকে অনেক দূরত্বে থাকতাম।
আম্মার দ্বিতীয় থিওরি ছিল যে - নিচু ক্লাসে পড়ার চাপ না থাকলে বড় হয়ে পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। এটার কিছু বাস্তব প্রমাণ আমি পেয়েছি। ক্লাস নাইন থেকে আমি পড়াতে মনোযোগী হই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ পর্যন্ত আমার আগ্রহ ছিল - দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পরে আমি আবার ক্লাস থ্রি মোডে চলে যাই। ইঞ্জিনিয়ারিং এর লেখাপড়া আমার অপছন্দ ছিল। এই শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পরও আমার কোন আগ্রহ জন্মে নি। এখনও নেই।
আম্মা অনেক পাঠ্যবই লিখেছেন। অনেক কারিকুলাম তৈরির কাজ করেছেন, স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষা দিয়েছেন, তাদের জন্য ম্যানুয়েল লিখেছেন। এই সবই ছিল তাঁর পেশাগত কাজ।
এর বাইরেও তাঁর অসাধারণ একটা দক্ষতা ছিল। তিনি ছিলেন অসামান্য গল্পকথক। তিনি মুখে মুখে গল্প বানিয়ে বলতেন। গল্পলেখক না বলে গল্পকথক বলতে হচ্ছে কেননা তিনি কোনদিন সেই সব মুখে মুখে বলা গল্প লেখার চেষ্টা করেন নি। বেশি লিখলে হাতে ব্যথা করে। অকাট্য যুক্তি।
আম্মা একটা গল্প বলেছিলেন যেটার নায়িকা ছিলেন তিনি নিজেই। তাঁর বাস ছিল পরীদের দেশে - সেখানে নানান ঘটনা ঘটে, শেষ পর্যন্ত তাঁকে সেই দেশ থেকে এই মানুষের পৃথিবীতে নির্বাসন নিতে হয়। পরীদের দেশের মেয়েদের পায়ের পাতা ছোট হয়, গল্পের শেষে তিনি প্রমাণ দিয়ে দেন যে তিনি আসলেই ওই দেশ থেকে এসেছেন। গল্পটা শুনে আমার খুবই দুঃখ হয়েছিল, মনে হয়েছিল, এতোসব গ্যাঞ্জাম না হলে আমিও ওই দেশে থাকতাম, এতো এতো পড়াশোনা করতে হতো না।
এই গল্পের একটা মারমেইড ভার্সান আমি আমার মেয়েকে শুনিয়েছি। সেইখানে আমিই নায়ক। আমাকে বাধ্য হয়ে মারমেইডদের দেশ ছাড়তে হয়, আমার নিবাস ছিল বেগুনবাড়ি খাল অর্থাৎ যেটার বর্তমান নাম হাতিরঝিল। এই গল্প শুনে আনুশারও খুব দুঃখ হয়েছিল, মারমেইডদের দেশ বাধ্য ছেড়ে আসাটা সম্পূর্ণ "নট ফেয়ার" একটা ঘটনা - কেননা আনুশার মারমেইড হওয়ার খুবই শখ।
ডিসেম্বর মাসে ডিজনি ওয়ার্ল্ডে গিয়েছিলাম। ছোটবড় সবারই হাঁ হয়ে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে সেইখানে। ওয়াল্ট ডিজনির কল্পনা ছিল সেই সাথে সাথে ব্যবসার বুদ্ধিও ছিল। এই দুইয়ের সংমিশ্রন সাধারণত পাওয়া যায় না, কল্পনাপ্রবণ মানুষেরা সাধারণত ব্যবসা ভালো বুঝে না। কিন্তু ওয়াল্ট ডিজনি বুঝতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান চাইলে যে কোন কিছু সম্ভব করতে পারে। ডিজনি চলচ্চিত্র দেখেও তা-ই মনে হয়।
কিন্তু কল্পনা করতে শেখাটাও একটা বড় গুণ, যেটা অর্জন করতে হয়। সেটা করতে গেলে প্রচুর বই পড়তে হয়, মাথার ভেতরে সিনেমা তৈরি করতে হয়, নিজেকেই সত্যজিৎ রায় হতে হয়। ডিজনির বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ ওইখানেই, ভদ্রলোকের প্রতিষ্ঠান শিশুদের জন্য কল্পনার রাজ্য তৈরি করে দিয়ে তাদের কল্পনার ধারটা সম্ভবত কমিয়ে দিচ্ছে। উনি তৈরি না করলে হয়ত প্রতিটি শিশুই নিজেরা একেকজন পিটার প্যান চলচ্চিত্র তৈরি করতো মাথার ভেতর।
আমার মা এই দেশে জন্ম নিলে অনায়াসে নাম করা শিশু সাহিত্যিক হতে পারতেন বলেই আমার মনে হয়। ডিজনিতে গিয়ে আমি বুঝলাম, ছোটবেলাতে মুগ্ধ হয়ে শোনা সেই সব গল্প আমার মনের কল্পনার রাজ্যের দরজাগুলো খুলে দিয়েছে, আমাকে চিন্তা করতে শিখেয়েছে, আমাকে ভাবিয়েছে। আমার নতুন করে উপলব্ধি হলো, সারা জীবনে একটি গল্পের বই না লিখেও আমার মা আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পকার - আমার দুঃসময় পাড়ি দেওয়ার জাহাজের রূপকার।