স্কুলে পরীক্ষার আগের রাত আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বলা যায় আমি ওই একটি দিনই প্রচুর লেখাপড়া করতাম। আমার জন্য ওই রাতটা ছিল রহস্য উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ের মতো। সারা বছর ধরে জমে থাকা রহস্যের জট আস্তে আস্তে খুলতে থাকতো। আমি নতুন নতুন জিনিস জানতে পারতাম, বছর জুড়ে হজম করা মারধোরটা অন্যায্য মনে হতো। সামনের বছর মন দিয়ে পড়তে হবে - এই প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার আগের রাতটা শেষ হতো।
মাঝের কিছু বছর বাদ দিলে আমি প্রায় সারাজীবন ধরেই এই কাজ করে গেছি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো মাঝে কয়েকদিন গ্যাপ থাকতো। আমি এবং আমার যাবতীয় বন্ধুবান্ধব ওই সময়েই বইয়ের পাতা প্রথম উল্টাতো। সারাবছর নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমরা ব্যস্ত থাকতাম, আমাদের এতো সময় কোথায়?
আমাদের সময়ে বুয়েটের পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রে দুটো অংশ থাকতো। প্রতিটি অংশে চারটি প্রশ্ন থাকতো। সেই চারটি প্রশ্নের মধ্যে তিনটির উত্তর করতে হতো। সেই প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি থাকতো ভয়ানক মাত্রার জটিল, যারা পরীক্ষার মাঝে মাঝে পড়াশুনা করে তাদের জন্য। বাকি তিনটা প্রশ্নের মধ্যে আমি আড়াইটার মতো উত্তর করতে পারতাম। মানে আমার স্ট্রাইক রেট ছিল ৮০ এর একটু উপরে। বুয়েটের খুব কম পরীক্ষাতেই আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি।
এইভাবে যারা পরীক্ষা দেয় তাদের জন্য পরীক্ষাটা জ্ঞান সাধনার চেয়ে অনেক বেশি স্ট্র্যাটেজিক গেইম। আমাদেরকে নানান অ্যাসাম্পশন করতে হতো, ঠিক কিভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যবহার করে সবচেয়ে ভালো ফল পেতে হবে এই বিষয়ে সাংঘাতিক গবেষণা করতে হতো।
তবে মাঝে মাঝে সব স্ট্র্যাটেজি ফেল মেরে যেতো। সেই সময়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাইতে হতো। আমার মতো যেই সব ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষার ঠিক আগে আগে বই খুলে বসে, তাদের প্রিপারেশনের একটা অংশ নিশ্চিতভাবেই ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ কামনা করা। উনিও সাহায্য করেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এইসব ছেলেপেলেদের পরীক্ষাতে সাহায্য করতে গিয়েই ঈশ্বর আর এই পৃথিবীর জটিল জটিল সব সমস্যা সমাধান করার সময় পান না।
তড়িৎ প্রকৌশলের দ্বিতীয় বর্ষ ছিল বিভীষিকার মতো। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা কোর্স নিতে হতো সেকেন্ড ইয়ারে, কোর্সের নাম ছিল থার্মোফ্লুইড মেকানিক্স। আমার সব সময়ে মনে হতো এই কোর্সের নামটা বাংলা ছায়াছবি থেকে অনুপ্রাণিত। মানে হচ্ছে "সুজন সখী" সিনেমার নায়ক ও নায়িকার নাম যেন সুজন আর সখী - ঠিক তেমনি থার্মোফ্লুইড মেকানিক্স কোর্সটা আসলে দুটো কোর্স, থার্মো ডাইনামিক্স আর ফ্লুইড মেকানিক্স। দুটো আসলেই আলাদা আলাদা কোর্স হিসাবে অফার করা হয়। তড়িৎ কৌশলের জন্য এক টিকেটে দুই ছবির মতো একত্রে ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
থার্মোফ্লুইড পরীক্ষার আগের ছুটিতে আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম যে এই কোর্স গ্যাপে পড়ে পাশ করার বিষয় নয়। এই ছাড়াও যেই স্যার প্রশ্ন করবেন তিনি ছাত্রদের ফেল করাতে ভালোবাসেন। বিচিত্র কারণে মেকানিক্যালের অধিকাংশ শিক্ষক ছাত্রদের ব্যক্তিগত শত্রু মনে করেন। আমি থার্মো ফ্লুইডে ডাব্বা মারার জন্য রেডি হতে লাগলাম।
ঈশ্বর এইবারও মুখ তুলে তাকালেন। পরীক্ষার দুই দিন আগে একদল সন্ত্রাসী বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকে স্যারদের গাড়ি ভাংচুর করে দিল। স্যারেরা সেই দুঃখে ধর্মঘটে গেলেন। আমাদের পরীক্ষা প্রায় একমাস পিছিয়ে গেল। আমার হিসাবে এই কোর্সের পড়া শেষ করতে ৭/৮ দিন লাগার কথা। আমি ঠিক ২৩ দিন পরে আবার পড়া শুরু করলাম এবং বিনা বাধাতে থার্মোফ্লুইড থেকে গলে বেরিয়ে এলাম।
পুরো ছাত্রজীবনে আমি একবার মাত্র ফেল করেছি। ক্লাস ফাইভের অংক পরীক্ষাতে। অংকে ১৯ পেয়েছিলাম। কিন্তু পরীক্ষাগুলো আমার কাছে ছিল জেমস বন্ডের মুভির মতো উত্তেজনাকর। বহু বহু বার আমার কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে, খাদের ধার থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি।
আনুশার আগামিকাল স্টার টেস্ট (Staar Test)। স্টারের অর্থ হচ্ছে - State of Texas Assessments of Academic Readiness, এটা টেক্সাস রাজ্যের শিক্ষাবিভাগের নেওয়া পরীক্ষা। ক্লাস থ্রি থেকে শুরু করে ক্লাস এগারো পর্যন্ত সবাইকেই বছরে দুটো বা তিনটা বিষয় পরীক্ষা দিতে হয়। আনুশার জায়গাতে আমি থাকলে আমি এখন দমবন্ধ করতে পড়তাম। কিন্তু আনুশার টিচার বলেছেন - পড়াশুনা না করে ঘুম দিতে। সকালে ভারি নাশতা করে পরীক্ষার হলে যেতে।
আনুশা একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়েছে। আমার জন্য বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা। তবে পুরনো বছরের স্টার টেস্টের প্রশ্ন দেখে আমিও একমত, এই পরীক্ষার জন্য পড়ে লাভ নেই। প্রশ্নপত্র হবে সৃজনশীল। সারা বছর না পড়লে এই পরীক্ষা থার্মোফ্লুইড মেকানিক্সের মতোই জটিল লাগবে। আনুশা আমার মেয়ে হলেও আমার মতো পরীক্ষার আগের রাতের ফাইটার নয়। সারা বছর পড়াশুনা করে সে পরীক্ষার আগের রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম দিতে চায়। আমি আনুশাকে দেখে ঈর্ষিত হই।
গুড লাক আনুশা - আমি ক্লাস ফোরে ফিরতে পারলে সারা বছর মন দিয়ে পড়ব - এই প্রতিজ্ঞা আবারও করছি। গুড লাক সুইট হার্ট।
মাঝের কিছু বছর বাদ দিলে আমি প্রায় সারাজীবন ধরেই এই কাজ করে গেছি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো মাঝে কয়েকদিন গ্যাপ থাকতো। আমি এবং আমার যাবতীয় বন্ধুবান্ধব ওই সময়েই বইয়ের পাতা প্রথম উল্টাতো। সারাবছর নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমরা ব্যস্ত থাকতাম, আমাদের এতো সময় কোথায়?
আমাদের সময়ে বুয়েটের পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রে দুটো অংশ থাকতো। প্রতিটি অংশে চারটি প্রশ্ন থাকতো। সেই চারটি প্রশ্নের মধ্যে তিনটির উত্তর করতে হতো। সেই প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি থাকতো ভয়ানক মাত্রার জটিল, যারা পরীক্ষার মাঝে মাঝে পড়াশুনা করে তাদের জন্য। বাকি তিনটা প্রশ্নের মধ্যে আমি আড়াইটার মতো উত্তর করতে পারতাম। মানে আমার স্ট্রাইক রেট ছিল ৮০ এর একটু উপরে। বুয়েটের খুব কম পরীক্ষাতেই আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি।
এইভাবে যারা পরীক্ষা দেয় তাদের জন্য পরীক্ষাটা জ্ঞান সাধনার চেয়ে অনেক বেশি স্ট্র্যাটেজিক গেইম। আমাদেরকে নানান অ্যাসাম্পশন করতে হতো, ঠিক কিভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যবহার করে সবচেয়ে ভালো ফল পেতে হবে এই বিষয়ে সাংঘাতিক গবেষণা করতে হতো।
তবে মাঝে মাঝে সব স্ট্র্যাটেজি ফেল মেরে যেতো। সেই সময়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাইতে হতো। আমার মতো যেই সব ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষার ঠিক আগে আগে বই খুলে বসে, তাদের প্রিপারেশনের একটা অংশ নিশ্চিতভাবেই ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ কামনা করা। উনিও সাহায্য করেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এইসব ছেলেপেলেদের পরীক্ষাতে সাহায্য করতে গিয়েই ঈশ্বর আর এই পৃথিবীর জটিল জটিল সব সমস্যা সমাধান করার সময় পান না।
তড়িৎ প্রকৌশলের দ্বিতীয় বর্ষ ছিল বিভীষিকার মতো। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা কোর্স নিতে হতো সেকেন্ড ইয়ারে, কোর্সের নাম ছিল থার্মোফ্লুইড মেকানিক্স। আমার সব সময়ে মনে হতো এই কোর্সের নামটা বাংলা ছায়াছবি থেকে অনুপ্রাণিত। মানে হচ্ছে "সুজন সখী" সিনেমার নায়ক ও নায়িকার নাম যেন সুজন আর সখী - ঠিক তেমনি থার্মোফ্লুইড মেকানিক্স কোর্সটা আসলে দুটো কোর্স, থার্মো ডাইনামিক্স আর ফ্লুইড মেকানিক্স। দুটো আসলেই আলাদা আলাদা কোর্স হিসাবে অফার করা হয়। তড়িৎ কৌশলের জন্য এক টিকেটে দুই ছবির মতো একত্রে ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
থার্মোফ্লুইড পরীক্ষার আগের ছুটিতে আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম যে এই কোর্স গ্যাপে পড়ে পাশ করার বিষয় নয়। এই ছাড়াও যেই স্যার প্রশ্ন করবেন তিনি ছাত্রদের ফেল করাতে ভালোবাসেন। বিচিত্র কারণে মেকানিক্যালের অধিকাংশ শিক্ষক ছাত্রদের ব্যক্তিগত শত্রু মনে করেন। আমি থার্মো ফ্লুইডে ডাব্বা মারার জন্য রেডি হতে লাগলাম।
ঈশ্বর এইবারও মুখ তুলে তাকালেন। পরীক্ষার দুই দিন আগে একদল সন্ত্রাসী বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকে স্যারদের গাড়ি ভাংচুর করে দিল। স্যারেরা সেই দুঃখে ধর্মঘটে গেলেন। আমাদের পরীক্ষা প্রায় একমাস পিছিয়ে গেল। আমার হিসাবে এই কোর্সের পড়া শেষ করতে ৭/৮ দিন লাগার কথা। আমি ঠিক ২৩ দিন পরে আবার পড়া শুরু করলাম এবং বিনা বাধাতে থার্মোফ্লুইড থেকে গলে বেরিয়ে এলাম।
পুরো ছাত্রজীবনে আমি একবার মাত্র ফেল করেছি। ক্লাস ফাইভের অংক পরীক্ষাতে। অংকে ১৯ পেয়েছিলাম। কিন্তু পরীক্ষাগুলো আমার কাছে ছিল জেমস বন্ডের মুভির মতো উত্তেজনাকর। বহু বহু বার আমার কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে, খাদের ধার থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি।
আনুশার আগামিকাল স্টার টেস্ট (Staar Test)। স্টারের অর্থ হচ্ছে - State of Texas Assessments of Academic Readiness, এটা টেক্সাস রাজ্যের শিক্ষাবিভাগের নেওয়া পরীক্ষা। ক্লাস থ্রি থেকে শুরু করে ক্লাস এগারো পর্যন্ত সবাইকেই বছরে দুটো বা তিনটা বিষয় পরীক্ষা দিতে হয়। আনুশার জায়গাতে আমি থাকলে আমি এখন দমবন্ধ করতে পড়তাম। কিন্তু আনুশার টিচার বলেছেন - পড়াশুনা না করে ঘুম দিতে। সকালে ভারি নাশতা করে পরীক্ষার হলে যেতে।
আনুশা একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়েছে। আমার জন্য বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা। তবে পুরনো বছরের স্টার টেস্টের প্রশ্ন দেখে আমিও একমত, এই পরীক্ষার জন্য পড়ে লাভ নেই। প্রশ্নপত্র হবে সৃজনশীল। সারা বছর না পড়লে এই পরীক্ষা থার্মোফ্লুইড মেকানিক্সের মতোই জটিল লাগবে। আনুশা আমার মেয়ে হলেও আমার মতো পরীক্ষার আগের রাতের ফাইটার নয়। সারা বছর পড়াশুনা করে সে পরীক্ষার আগের রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম দিতে চায়। আমি আনুশাকে দেখে ঈর্ষিত হই।
গুড লাক আনুশা - আমি ক্লাস ফোরে ফিরতে পারলে সারা বছর মন দিয়ে পড়ব - এই প্রতিজ্ঞা আবারও করছি। গুড লাক সুইট হার্ট।