Monday, April 20, 2015

পরীক্ষার পূর্বরাত্রি

স্কুলে পরীক্ষার আগের রাত আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বলা যায় আমি ওই একটি দিনই প্রচুর লেখাপড়া করতাম। আমার জন্য ওই রাতটা ছিল রহস্য উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ের মতো। সারা বছর ধরে জমে থাকা রহস্যের জট আস্তে আস্তে খুলতে থাকতো। আমি নতুন নতুন জিনিস জানতে পারতাম, বছর জুড়ে হজম করা মারধোরটা অন্যায্য মনে হতো। সামনের বছর মন দিয়ে পড়তে হবে - এই প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার আগের রাতটা শেষ হতো।

মাঝের কিছু বছর বাদ দিলে আমি প্রায় সারাজীবন ধরেই এই কাজ করে গেছি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো মাঝে কয়েকদিন গ্যাপ থাকতো। আমি এবং আমার যাবতীয় বন্ধুবান্ধব ওই সময়েই বইয়ের পাতা প্রথম উল্টাতো। সারাবছর নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমরা ব্যস্ত থাকতাম, আমাদের এতো সময় কোথায়?

আমাদের সময়ে বুয়েটের পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রে দুটো অংশ থাকতো। প্রতিটি অংশে চারটি প্রশ্ন থাকতো। সেই চারটি প্রশ্নের মধ্যে তিনটির উত্তর করতে হতো। সেই প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি থাকতো ভয়ানক মাত্রার জটিল, যারা পরীক্ষার মাঝে মাঝে পড়াশুনা করে তাদের জন্য। বাকি তিনটা প্রশ্নের মধ্যে আমি আড়াইটার মতো উত্তর করতে পারতাম। মানে আমার স্ট্রাইক রেট ছিল ৮০ এর একটু উপরে। বুয়েটের খুব কম পরীক্ষাতেই আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি।

এইভাবে যারা পরীক্ষা দেয় তাদের জন্য পরীক্ষাটা জ্ঞান সাধনার চেয়ে অনেক বেশি স্ট্র্যাটেজিক গেইম। আমাদেরকে নানান অ্যাসাম্পশন করতে হতো, ঠিক কিভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যবহার করে সবচেয়ে ভালো ফল পেতে হবে এই বিষয়ে সাংঘাতিক গবেষণা করতে হতো।

তবে মাঝে মাঝে সব স্ট্র্যাটেজি ফেল মেরে যেতো। সেই সময়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাইতে হতো। আমার মতো যেই সব ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষার ঠিক আগে আগে বই খুলে বসে, তাদের প্রিপারেশনের একটা অংশ নিশ্চিতভাবেই ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ কামনা করা। উনিও সাহায্য করেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এইসব ছেলেপেলেদের পরীক্ষাতে সাহায্য করতে গিয়েই ঈশ্বর আর এই পৃথিবীর জটিল জটিল সব সমস্যা সমাধান করার সময় পান না।

তড়িৎ প্রকৌশলের দ্বিতীয় বর্ষ ছিল বিভীষিকার মতো। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা কোর্স নিতে হতো সেকেন্ড ইয়ারে, কোর্সের নাম ছিল থার্মোফ্লুইড মেকানিক্স। আমার সব সময়ে মনে হতো এই কোর্সের নামটা বাংলা ছায়াছবি থেকে অনুপ্রাণিত। মানে হচ্ছে "সুজন সখী" সিনেমার নায়ক ও নায়িকার নাম যেন সুজন আর সখী - ঠিক তেমনি থার্মোফ্লুইড মেকানিক্স কোর্সটা আসলে দুটো কোর্স, থার্মো ডাইনামিক্স আর ফ্লুইড মেকানিক্স। দুটো আসলেই আলাদা আলাদা কোর্স হিসাবে অফার করা হয়। তড়িৎ কৌশলের জন্য এক টিকেটে দুই ছবির মতো একত্রে ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

থার্মোফ্লুইড পরীক্ষার আগের ছুটিতে আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম যে এই কোর্স গ্যাপে পড়ে পাশ করার বিষয় নয়। এই ছাড়াও যেই স্যার প্রশ্ন করবেন তিনি ছাত্রদের ফেল করাতে ভালোবাসেন। বিচিত্র কারণে মেকানিক্যালের অধিকাংশ শিক্ষক ছাত্রদের ব্যক্তিগত শত্রু মনে করেন। আমি থার্মো ফ্লুইডে ডাব্বা মারার জন্য রেডি হতে লাগলাম।

ঈশ্বর এইবারও মুখ তুলে তাকালেন। পরীক্ষার দুই দিন আগে একদল সন্ত্রাসী বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকে স্যারদের গাড়ি ভাংচুর করে দিল। স্যারেরা সেই দুঃখে ধর্মঘটে গেলেন। আমাদের পরীক্ষা প্রায় একমাস পিছিয়ে গেল। আমার হিসাবে এই কোর্সের পড়া শেষ করতে ৭/৮ দিন লাগার কথা। আমি ঠিক ২৩ দিন পরে আবার পড়া শুরু করলাম এবং বিনা বাধাতে থার্মোফ্লুইড থেকে গলে বেরিয়ে এলাম।

পুরো ছাত্রজীবনে আমি একবার মাত্র ফেল করেছি। ক্লাস ফাইভের অংক পরীক্ষাতে। অংকে ১৯ পেয়েছিলাম। কিন্তু পরীক্ষাগুলো আমার কাছে ছিল জেমস বন্ডের মুভির মতো উত্তেজনাকর। বহু বহু বার আমার কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে, খাদের ধার থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি।

আনুশার আগামিকাল স্টার টেস্ট (Staar Test)। স্টারের অর্থ হচ্ছে - State of Texas Assessments of Academic Readiness, এটা টেক্সাস রাজ্যের শিক্ষাবিভাগের নেওয়া পরীক্ষা। ক্লাস থ্রি থেকে শুরু করে ক্লাস এগারো পর্যন্ত সবাইকেই বছরে দুটো বা তিনটা বিষয় পরীক্ষা দিতে হয়। আনুশার জায়গাতে আমি থাকলে আমি এখন দমবন্ধ করতে পড়তাম। কিন্তু আনুশার টিচার বলেছেন - পড়াশুনা না করে ঘুম দিতে। সকালে ভারি নাশতা করে পরীক্ষার হলে যেতে।

আনুশা একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়েছে। আমার জন্য বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা। তবে পুরনো বছরের স্টার টেস্টের প্রশ্ন দেখে আমিও একমত, এই পরীক্ষার জন্য পড়ে লাভ নেই। প্রশ্নপত্র হবে সৃজনশীল। সারা বছর না পড়লে এই পরীক্ষা থার্মোফ্লুইড মেকানিক্সের মতোই জটিল লাগবে। আনুশা আমার মেয়ে হলেও আমার মতো পরীক্ষার আগের রাতের ফাইটার নয়। সারা বছর পড়াশুনা করে সে পরীক্ষার আগের রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম দিতে চায়। আমি আনুশাকে দেখে ঈর্ষিত হই।

গুড লাক আনুশা - আমি ক্লাস ফোরে ফিরতে পারলে সারা বছর মন দিয়ে পড়ব - এই প্রতিজ্ঞা আবারও করছি। গুড লাক সুইট হার্ট।


Thursday, April 16, 2015

শিম্পাঞ্জি

সামারার পছন্দের তালিকাতে আসতে হলে কি যোগ্যতা লাগবে সেটা আমি বের করে ফেলেছি। ওখানে ঢুকতে হলে লোমশ এবং সম্ভব হলে নাদুস-নুদুস হতে হবে। সেই কারণেই লিস্টের এক নম্বরে আছে বিড়াল, মোটা বিড়াল হলে ভালো হয়, দুই নম্বরে কুকুর - তিন নম্বরে আছে শিম্পাঞ্জি।

আমি ছোটবেলাতে যেই সব জিনিসকে ইতর জিনিস বা গালাগাল হিসাবে জেনেছি সেইগুলোই দেখা যাচ্ছে সামারার লিস্টের উপরের দিকে থাকে। আতাহার হোসেন স্যার রেগে গেলে "হনুমান স্টুপিড" বলে গালাগাল করতেন। হালদার স্যার "লেজখসা বানর" বলতেন। সারমেয়র ছানা-পোনা এবং বরাহ শাবকও বেশ খারাপ গালি বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু বড় হওয়ার আমি দেখেছি এইগুলো সামারার বিবেচনাতে খুবই কিউট প্রাণী। ভালো লক্ষ্য করার পরে আমিও এই বিষয়ে একমত। 

 শিম্পাঞ্জি বললেই জেন গুডালের নাম চলে আসে। "হু ইজ জেন গুডাল?" বইটা পড়লে আমরা জানতে পারি যে জেন গুডালের জন্ম লন্ডন শহরে - ১৯৩৪ সালে। তাঁর বয়েস যখন এক বছর তখন তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে একটা পুতুল শিম্পাঞ্জি উপহার পান। সেই বছরই প্রথম লন্ডন চিড়িয়াখানাতে একটা বাচ্চা শিম্পাঞ্জির জন্ম হয়, জঙ্গলের বাইরে সেটাই ছিল জন্ম নেওয়া প্রথম শিম্পাঞ্জি। সেই বাচ্চা শিম্পাঞ্জিটার নাম ছিল জুবিলি - সেটার সাথে নাম মিলিয়ে জেন গুডালের খেলার পুতুল শিম্পাঞ্জিটারও একই নাম রাখা হয়। জেন সর্বত্রই জুবিলিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো এবং এই শিম্পাঞ্জি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তাঁর শৈশবেই থেমে থাকে নি। তিনি সারা জীবন শিপাঞ্জি নিয়েই কাজ করেছেন। অবধারিতভাবেই তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থের নাম - My Life with the Chimpanzees।

শুধু নিজে যে করেছেন তা-ই নয়, বহু বহু মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছেন জেন গুডালের কাজে। সচলায়তনে তারেক অণু লিখেছেন...

"সারা বিশ্বে বর্তমানে যত জন প্রাইমেটোলজিস্ট ( যারা প্রাইমেটদের নিয়ে কাজ করেন ) আছেন তদের শতকরা ৯৫ জনই এই বিষয়ে গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জেন গুডালের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে। গত ৫০ বছরের বেশী সময় ধরে শিম্পাঞ্জীদের নিয়ে গবেষণা এবং তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন এই মহীয়সী।"

লিঙ্কঃ তারেক অণুর জেন গুডালকে নিয়ে লেখা

 বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে সামারাকেও তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন। সিনেমা হলে প্রায়ই প্রাণীজগত নিয়ে ডকুমেন্টারি টাইপের মুভি আসে। সামারা সেইগুলোর খবর রাখে। নতুন ছবি মুক্তি পেলেই আমরা সেইগুলো দেখতে যাই। কয়েক বছর আগে শিম্পাঞ্জি নিয়ে ডিজনির ডকুমেন্টারি দেখতে গিয়েছিলাম। এই ছবিটা বানানোর পেছনে জেন গুডালের ভূমিকা আছে।

শিম্পাঞ্জি বা বাঁদরগোত্রীয় প্রাণী নিয়ে ডকুমেন্টারি আমিও দেখতে চাই। ওদের এবং আমাদের, মানে মানুষদের পূর্বপুরুষ একই, অর্থাৎ এক সময়ে আমরা হরিহর আত্মা ছিলাম - বর্তমানে বিবর্তনের দৌড়ে আমরা এগিয়ে গিয়েছি (সভ্য হয়েছি এই দাবী করা অসম্ভব)। ওদের ব্যাপার আমার কৌতুহল প্রাচীন। 

 ছবিটার কাহিনি এই রকম - গল্পের নায়ক অস্কার বনের শিশু শিম্পাঞ্জি। তার শৈশব আনন্দময়। তাদের জঙ্গলে খাবারের অভাব নেই। অস্কার সারাদিন তার মা ঈষার সাথে লেপ্টে থাকে। শিম্পাঞ্জিরা দলবদ্ধ জীব। ওরা টুকটাক টুল বানাতে পারে। প্রকৃতির পাঠশালাতে অস্কার শিক্ষানবীস, ঈষার দায়িত্ব শিক্ষকের। শৈশব খুব আনন্দের হওয়ার কথা। সেই রকমই হচ্ছিল। কিন্তু পুষ্পে কীট সম - সর্বত্রই তৃষ্ণা জেগে রয়। ওই জংগলে শিম্পাঞ্জিদের দুটো দল ছিল। তাদের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। বরং প্রায় নিয়মিতই গ্যাঞ্জাম লেগে থাকতো। দুই বিবদমান দলের এক সংঘর্ষে অস্কারের মা ঈষা আহত এবং নিহত হয়।

অস্কার বুঝতেও পারেনি যে তার মা আর নেই। সে নানান জায়গাতে তার মায়ের খোঁজ করে। তার অবস্থা সেই হারিয়ে যাওয়া পাখির বাচ্চার মতো। জঙ্গলে বাস করার নানান বিদ্যাও সে শিখতে পারে নি, সুতরাং একা একা জীবন ধারণ করাও অসম্ভব তার জন্য। মা-কে খুঁজে না পেয়ে সে অন্যান্য শিম্পাঞ্জিদের কাছে আশ্রয় খুঁজে এবং ব্যর্থ হয়। এই পর্যায়ে অনাথ অস্কারের মৃত্যু প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়ে।

অস্কার শেষ পর্যন্ত শিম্পাঞ্জি গোত্রের লিডার ফ্রেডির কাছে যায়। ফ্রেডি পিছে পিছে সে ঘুরতে থাকে। ফ্রেডি রাজনৈতিক নেতাদের মতো। তার মূল কাজ পিটাপিটি আর মারামারি। অনাথ শিশু প্রতি সদয় হওয়ার কোন ইচ্ছেই তার মধ্যে ছিল না। কিন্তু কি এক মায়ামন্ত্রবলে ফ্রেডি আর অস্কার আস্তে আস্তে কাছে আসে। তাদের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। অস্কার শেষ পর্যন্ত প্রায় ফ্রেডির পালকপুত্রে পরিণত হয়।


ছবিটা দেখে সামারার চোখ অশ্রুসজল হয়ে গিয়েছিল। অস্কারের জন্য আমিও বেদনা ও আনন্দ দুটোই অনুভব করেছিলাম। সেই সঙ্গে মানুষের নিকটতম আত্মীয়ের মধ্যেও অমানুষিক ছায়া দেখে চমকেও গিয়েছিলাম। ছবিটা ছিল একটি আই-ওপেনার। প্রকৃতি বললেই একজন উদার ভদ্রলোকের ছবি ভেসে উঠতো আমার মনে, কিন্তু বাস্তবে প্রকৃতি বেশ খতরনাক প্রকৃতির লোক। তার কিছু অংশ প্রায় জর্জ বুশের মতো। জোর যায় মুল্লুক তার। কিন্তু নির্মম বাস্তবে ছুঁড়ে ফেলাটা প্রকৃতির যেমন অবধারিত নিয়তি, তেমনি ফ্রেডির মধ্যে জেগে ওঠা অপত্যস্নেহটাও প্রকৃতিরই নিয়ম।

মানুষের চরিত্রের প্রতিটি বৈপরীত্য - হিংস্রতা, ভালোবাসা, ক্রোধ, স্নেহ, প্রতিটা পর্বই যেন বিবর্তনের পরিক্রমাতে আর ধারালো হচ্ছে। শিম্পাঞ্জিদের চেয়ে আমরা মানুষেরা বিবর্তনের দৌড়ে এগিয়ে আছি, আমাদের ক্রোধ আর হিংসা যেমন ওদের চেয়েও নিঁখুত তেমনি আমাদের ভালোবাসাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওদের চেয়ে ব্যাপক। শিম্পাজিরা বড়জোর নিজেদের মাথা ফাটাতে পারে কিন্তু মানুষেরা জীব এবং জড় যা যা কিছু আছে তাদের সব কিছুই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম এবং প্রস্তুত।


শিম্পাজি মুভিটা ইউটিউবে আপলোড হয়েছে।




ছবিটার পোস্টার। ছবি সূত্র উইকিপিডিয়া।



সেই সঙ্গে সত্যিকারের জেন গুডাল আর আমাদের বাসার জেন গুডালের ছবি জুড়ে দিলাম। সত্যিকারের জেন গুডালের ছবি উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া।





[এই লেখাটা সচলায়তনে আমার প্রিয় মুখ তারেক অণুকে উৎসর্গ করছি]