Friday, April 29, 2011

স্মৃতিচিহ্ন


মিঠুর নাম বড়মিয়া কেন হোল সেটা একটু চিন্তা করে বের করতে হয়েছে। ওর সাথে আমাদের পরিচয় আশির দশকের মধ্যভাগে, মানিকগঞ্জের ছেলে ছিল ও। ওই সময়ে একটা সিনেমার গান ছিল যার প্রথম লাইনটা ছিল..."মানিকগঞ্জের বড়মিয়া..."। ওর নামটার সূত্রপাত মনে হয় ওই গানটাই।

গতরাতে মিঠু চলে গেছে না ফেরার দেশে। অনেকদিন ধরেই অসুখে ভুগছিল, হয়ত শান্তি হয়েই এসেছে এই মৃত্যু। আমি অনেক চিন্তা করলাম মিঠুর কথা। কোন স্মৃতিই মনে পড়ল না, শুধু ওরা মুখটা ছাড়া। ছেলেটা চুপচাপ ছিল, বেশি কথা বলত না। ওর সাথে সবাই মিলে অনেকবার মানিকগঞ্জে গিয়েছে শুধু কোন কারণে আমারই যাওয়া হয় নি। এটা ওকে বলার পরে আমাকে সে নিয়ে যাবে বলেছে। সেটাও বিশ বছর আগের কথা। এরপরও দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, বিদেশ যাওয়ার আগে বিদায় নিয়েছি।

বিদেশে আসলে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। আমি নিজেও হারিয়ে গেছি- খুব অল্প কিছু মানুষের স্মৃতি ছাড়া আমার অস্তিত্বও নেই আমার নিজের শহরে। হয়ত বড়মিয়াও ভুলে গিয়েছিল আমার কথা। কিন্তু ওর অসুস্থতার খবর আমি ঠিকই পাই। কিন্তু আর দেখা হয় নি। ওকে আমার হাসপাতালের বেডে দেখতে হয় নি, কিডনি ডায়ালাইসিসের সময়ে দেখতে হয় নি, মৃত্যুশয্যায় দেখতে হয় নি, শেষযাত্রায় দেখতে হয় নি। তাই আমার কাছে ও এখন রয়ে গেছে পঁচিশ বছরের এক চুপচাপ যুবক, যে শান্তস্বরে কথা বলে, যার কথা বুকের কোন একস্থানে রয়ে যায়।

জীবন যত দীর্ঘ হয়, ততই শোক গ্রহণ করতে হয় তাকে। বড়মিয়ার মৃত্যুসংবাদ আমাদের শুনতে হয়েছে, আমাদের মৃত্যুর কারো খবর ওকে আর শুনতে হবে না...বড় বেঁচে গেছিস তুই। তুই থেমে থাকবি চল্লিশেই, এই জীবনের প্রাপ্তি, দুঃখ-কষ্ট, বেদনা অথবা আনন্দের ভাগ আর তোকে নিতে হবে না।

এই এতোগুলো বছর পরে আমার কাছে বড়মিয়ার একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন ওর যৌবনের উজ্জ্বল মুখটা। ওকে শেষ দেখা দেখতে না পাওয়ার বেদনা আমার নেই- এক ইন্দ্রজালে বড়মিয়া এখনও যুবক রয়ে গেছে আমার কাছে...বেঁচে থাকুক এই স্মৃতিচিহ্ন।

Thursday, March 10, 2011

ঋণ, রাজনীতি আর নোবেল প্রাইজ

ইউনূস সাহেবকে নিয়ে আমার বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। আমি যেই শহরে থাকি সেই শহরে উনি কয়েকবার এসেছেন। আমি একবার কথাও বলেছি উনার সাথে। সুদের হার নিয়ে প্রশ্ন করেছি ওনাকে, ওনার উত্তর ছিল ঝানু ব্যাংকারের মত। হিসেব কষে আমাকে বুঝালেন যে গ্রামীন ব্যাঙ্ক অন্যদের চেয়ে বেটার। কিন্তু ওনার নোবেল প্রাপ্তিতে আমিও খুশি হয়েছি, আর দশজন বাংলাদেশির মত।

ঋণ খারাপ না ভালো এই প্রশ্নের উত্তর সহজ। ঋণ খারাপ, খুবই খারাপ। কিন্তু বাপের টাকা না থাকায় ঋণ করেই পড়েছি। চাকরি করে শোধ করেছি ঋণ। ঋণ করে বাড়ি কিনেছি, গাড়ি কিনেছি...শোধ করে যাচ্ছি...ঋণ ভালো না হলেও জীবনে ঋণ করতে হয় প্রায় সবাইকেই। সবাই ঋণের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারে না, কেউ ঋণ করে পড়াশোনা বা ব্যবসা করে স্বচ্ছলতা আনবে আবার কেউ ঋণের টাকায় ঘি খাবে। কারো ব্যবসা ফেল বা লে-অফ হয়ে ঋণখেলাপি হবে। এটা ঋণের সহজ সত্য।

ইউনূসকে সুদখোর বললে দেশে যত ব্যবসায়ী বা ব্যাঙ্কার আছে সবাইকে মহাজন বলতে হয়- কেননা সুদ সবাই খাচ্ছেন। অনেক রিটায়ার্ড সরকারী কর্মকর্তাও সঞ্চিত টাকাগুলোর সুদেই চলছেন। এই সুদ ব্যাঙ্ক দিচ্ছে কিভাবে? ওরা তো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়।

ইউনূস সাহেবের আইডিয়াটা ইউনিক, উনি যাদের ঋণ দিয়েছেন তারা সাধারণ বিচারে ঋণ পাওয়ার "যোগ্য" নয়। ধনী-গরীব নির্বিশেষে ঋণকারীর চরিত্র প্রায় একই। ঋণ পাওয়ার পরে ওদের মধ্যে কেউ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে অথবা কেউ তলিয়ে যাবে ঋণের অতলে। কিন্তু ঋণ অবশ্যই অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে। কিন্তু সাইড এফেক্ট ছাড়া নয়।

অপরিনামদর্শী ঋণগ্রহণ মার্কিন অর্থনীতিকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। এই ব্যাপারে ব্যাঙ্কের চেয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে দোষারোপ করা হয় অনেক বেশি। এটা যথার্থ, কেননা সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে অনেকটাই রেগুলেটরি। যদি অন্যায্য আচরণ হয়, সেটা প্রতিকার করা। গ্রামীন ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। গ্রামীন ব্যাঙ্ককে সংশোধন করা অথবা এর অনিয়ম নিয়ে একটা গ্রহনযোগ্য তদন্ত করা যেত, কিন্তু মহাজোট সরকার সেটা করেনি এবং হয়ত করবেও না। এই সরকারের সেই মেধা আছে, সেটাও মনে হয় না। ব্যাংকের প্রধানের "চাকরি নট" করে আর যাই হোক ক্ষুদ্রঋণের ভুক্তভোগীদের উপকার হয় না।

ইউনূস সাহেবের বহিষ্কারকে অনেকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ বলেছেন কেউ কেউ। উনি ১/১১ পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন, মার্কিনিদের পছন্দের লোক, বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় আমেরিকা আর সামরিক শাসন চায় না, এই ধরনের “সুশীল” শাসকই তাদের পছন্দ। এটা আমি মানতাম, কিন্তু ইউনূস সাহেবকে পদচ্যুত করে আর চার-পাঁচটা মামলা দিয়ে তাঁর কী রাজনৈতিক ক্ষতি হোলো সেটা কেউ খুলে বলেলনি। আর ইউনূস সাহেব ছাড়াও মার্কিনিদের আরো পছন্দের লোক আছে দেশে। বাকিরা সবাই কেন সরকারের কোপানলে নেই?

৭০ বছর বয়েসে কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু মার্কিনিদের সমর্থনে তিনি ফেসবুক আর সেনাসমর্থিত বিপ্লব করে ফেলবেন এটা মনে হয় না। আরব দেশের বাস্তবতা আর আমাদের বাস্তবতা এক নয়, আমাদের দেশের মানুষ শাসককুলের ভুলের পরিণাম তাদেরকে অচিরেই ধরিয়ে দেয়, সেটা ভোটে হোক আর রাজপথেই হোক। ইউনূস সাহেব সেটা বুঝেন বলেই ১/১১ পরে তিন মাসের বেশি রাজনীতি করেন নি।

ক্ষুদ্রঋণের ভুক্তভোগীদের ত্রানের জন্য নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল নয়, তাহলে ইউনূস সাহেবের এই পদচ্যুতি কেন?


শান্তিতে নোবেল প্রাইজ কোনো মহার্ঘ্য বস্তু নয়, অশান্তি তৈরি করে সেটাতে দুই ফোঁটা জল ঢেলে অনেকেই শান্তির নোবেল বাগিয়েছেন। আবার সারাজীবন মানুষের জন্য কাজের স্বীকৃতি হিসেবে মাদার টেরেসাও পেয়েছেন এই পদক। শান্তির নোবেল বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। ইউনূস সাহেব নোবেল পাওয়ার পরে উনাকে দেশের পত্রিকাগুলো নব্যুওয়াত প্রাপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে, ঠিক যেমনি বাংলাদেশ দল একটা খেলায় জিতলে তাদের আকাশে তোলা হয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর খেলা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, শোনা যায় উনি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির জন্য নোবেলের তদবীর করেছিলেন। উনার প্রধান উকিলও মনে করেন ইউনূসের আগেই শেখ হাসিনার নোবেল পাওয়া উচিত ছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির ব্যাপারে উনি নোবেল পেতে পারেন, এখনো পারেন। ভবিষ্যতে শান্তি আনব, এইজন্য বাকিতে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ওবামা, সেই তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনা অনেক সলিড কাজ। তবে শেখ হাসিনা নোবেল পাওয়ার আগে ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তিটা ভালো হয়নি ওনার জন্য। মালিকের ছেলের আগে বুয়ার ছেলে বৃত্তি পেলে বুয়ার “চাকরি নট” হতে পারে।

তাই কী হচ্ছে আসলে?