লালয়েৎ পঞ্চবর্ষাণি, দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ।
প্রাপ্তেষু ষোড়শে বর্ষে পুত্রমিত্রবদাচরেৎ।
এটা হচ্ছে পুত্র মানুষ করার ব্যাপারে চাণক্যর উপদেশ। আম্মার কাছে শুনেছি। প্রথম ৫ বছর আদর করতে হবে, এর পরের ১০ বছর তাড়য়েৎ, অর্থাৎ মাইরের উপর রাখতে হবে। পুত্রের বয়েস ১৬ হলে পিতা পুত্রের সাথে মিত্র বা বন্ধুর মতো আচরণ করবে। চাণক্য কন্যা সন্তানের ব্যাপারে কোন নির্দেশনা দিয়ে জাননি। জ্ঞানীগুনী লোক একটু সেক্সিস্ট টাইপের হয়, ওইগুলো নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে।
আমি আনুশার বন্ধুই ছিলাম। প্রায় জন্মের পর থেকেই। আনুশার জন্মের পরে একটা মহাসত্য আবিষ্কার করেছিলাম। সেটা হচ্ছে এই দেশে প্রায় সব প্রবাসীদের বাচ্চারা সাধারণত দুটো মাত্র মানুষকে চিনে। তারা শুধু বাচ্চার মা আর বাবা নন, একই সঙ্গে নানী, দাদী, কাকা, কাকী, মামা, মামী থেকে শুরু করে প্রধান বিচারপতি বা স্পোর্টস ফেডারেশনের চেয়ারম্যানের ভূমিকাও পালন করেন। দেশের প্যারেন্টদের এতো বহুমুখী ভূমিকা নিতে হয় না সম্ভবত। বাবা মা বকা দিলে অন্য কারো কাছে যাওয়া যায়।
বাচ্চাদের বন্ধু হওয়া কঠিন না। আনুশা আমাকে বন্ধু হিসাবে খুব দ্রুতই মেনে নিলো। আমরা বিকেলে পার্কে যাই, বাসায় ফিরে আমি ঘোড়া সাজি, বাথরুম হলে আমি ডায়পার পাল্টে দেই, দুধ গরম করে বোতলে ভরে নিয়ে আসি। বড় মানুষদের বন্ধু হওয়া কঠিন, কিন্তু বাচ্চারা আপনাকে খুব সামান্যতেই মেনে নিবে, উচ্চাসনে বসাবে। ছবি আঁকার কথাই ধরা যাক। গোসল করার সময়ে শাওয়ার বক্সের দেওয়ালের বাষ্পে আমি বিড়ালের ছবি আঁকলাম একদিন। আনুশা সাথে সাথে জানালো এটা সক্স (যে বাসার বাইরের বাগানে বসে হাই তুলে)। আমার কাঠি কাঠি ছবিগুলো আনুশার কাছে ভ্যান গঁগের শিল্পকর্মের মর্যাদা পেল। বিড়াল আঁকার পরে আঁকার স্লেটে আঁকলাম বাথরুমের কমোড। আনুশার বিস্ময় আকাশে উঠে গেল। বাথরুমের দরজা খুলে সে একবার দেখে এলো - আব্বু এইটা বাত্তুন, বাত্তুন, বাত্তুন– আনুশা হেসে কুটিকুটি।
আনুশার অনুরোধে (এবং আরও অনেক বাচ্চার অনুরোধে) আমি বিড়াল আর কমোড প্রচুর পরিমাণে এঁকেছি। আমি চাইল্ড সাইকোলজিস্ট না কিন্তু এই দুটো জিনিস বাচ্চাদের নির্মল আনন্দ দেয় সেটা বুঝতে পারি। ছোট্ট আনুশার বন্ধু হতে হলে আরেকটা জিনিস দরকার, সেটা হচ্ছে লুকোচুরি খেলা। খেলার প্রথম রাউন্ডে আনুশা লুকালো একতলার ক্লজেটে, আমি অনেক সময় নিয়ে খুঁজে বের করলাম। এরপর আমি একই জায়গাতে লুকালাম, আনুশা খুঁজে বের করলো। এরপর আমি একই জায়গাতে, তারপর আনুশাও একই জায়গাতে...একবার আমি এই চক্র ভেঙ্গে লন্ড্রি রুমে লুকালাম। ক্লজেটের ভেতর আমাকে দেখতে না পেয়ে আনুশার কাঁদো কাঁদো জিজ্ঞাসা - আব্বু আর ইউ লস্ট? আমি এরপর থেকে সব সময়ে ক্লজেটেই লুকিয়েছি যাতে আর কখনো হারিয়ে না যাই।
আনুশার সাথে আমার ফরেভার থাকার কথা। আমি যখন আকাশে তারা হয়ে যাবো, আনুশাও কাছাকাছি একটা তারা হয়ে যাবে - আমরা সব প্ল্যান ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে আনুশা বড় হয়ে গেল। এখন আনুশা আর আমার বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করে না। যেই জগতটাতে সে ডানা মেলছে তাতে আরও বড় বড় স্বপ্ন আছে, আছে আনন্দ, আছে হরেক রকম মজাদার জিনিস, পৃথিবী আসলে এক ঝলমলে মনোহারী দোকানের মতো, কিন্তু এর রকমারী জিনিসের ভাঁজে ভাঁজে কত কত বিষাদ লুকানো থাকে!! আনুশা আর আমার হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত না, সেই ভয় যেন ভর করেছে আমারই উপর।
আনুশার আজকে ১৬ বছর হয়ে গেল। দুঃখের বিষয় আমি আর আনুশার বন্ধুর তালিকাতে নেই। আমাকে দেখলে ফোনের আলাপ বন্ধ হয়ে যায়, ওর সেই জগতে আমার আর প্রবেশধিকার নেই। আমি সেই চেষ্টাও করি না, আমি আছি দর্শকের সারিতে। আমি তাতেও খুশি - কেননা আমি জানি অনেক অনেক দিন পরে আমি হয়ত আবারও আনুশার বন্ধু হতে পারবো। ১৬ তে না পারি ৬১ তে হয়ত হব!!!
অনেক বড় হও আনুশা, এই মিথ্যে কথা ভরা পৃথিবীতে সত্যিকারের মানুষ হও।
শুভ জন্মদিন আনুশা!!! শুভ জন্মদিন!!!
No comments:
Post a Comment