Friday, December 25, 2020

ডাউনআন্ডার ৩ঃ বারো শিষ্যের দেশে

নতুন দেশ আবিষ্কারের একটা আনন্দ আছে। কলম্বাসের মতো দেশ দখল আর সম্পদ লুন্ঠনের আনন্দ না। অজানাকে জানার আনন্দ। নিজের পরিসীমা ভেদ করে যাওয়ার আনন্দ, প্রতিদিন যে পথ দিয়ে হেঁটে যেতে হয়, সেটার বাইরেও যে অনেক অনেক বড় একটা পৃথিবী আছে, সেই পৃথিবীর স্বাদ আর গন্ধ নেওয়ার আনন্দ। মুক্তিবেগে সবাই অর্জন করতে পারে না - কিন্তু এরপরেও জানালা দিয়ে বিশ্বসংসার দেখা সম্ভব। আমি নতুন দেশ আবিষ্কারের আনন্দ পেয়েছিলাম শৈশবেই - একদিন তেজগাঁ থেকে রেললাইন ধরে হেঁটে গিয়েছিলাম নাখালপাড়াতে। নাখালপাড়া রেলক্রসিং থেকে পশ্চিম দিকে হেঁটে নতুন একটা ছিমছাম পাড়া দেখেছিলাম। একটা রাস্তার নাম এখনও মনে আছে - ব্যাঙ্কার'স রো। আমার জন্য সেই যাত্রা এক বিস্ময়যাত্রা - বিকেলে বেরিয়ে বিশ্বভ্রমণ শেষে সন্ধ্যের আগেই বাসাতে পৌঁছে গেছি। নতুন একটা দেশ আবিষ্কার করে জমিয়ে রাখতে হয়, সেই বাল্যকাল থেকে আমি জানি। 

ওয়ার্নাম্বুল থেকে আমাদের ঘুরপথে মেলবোর্ন ফেরার কথা। এবার ফিরব সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে। আমি নতুন কোন জায়গাতে গেলেই সেই শৈশবের উত্তেজনাটা বোধ করি। আমরা সকাল সকাল বের হয়েছি। সারাদিন পথে পথে থেমে থেমে মেলবোর্ন পৌঁছাবো বিকেলে বা সন্ধ্যাতে। কোথাও কোন তাড়া নেই। ঘর থেকে বের হয়ে আমরা ছোট এক রাস্তা ধরলাম। চারিদিকে শুনশান নিরবতা, কোথাও সমুদ্রের দেখা নেই। চারিদিকে ছোট ছোট গাছ, ঝোপঝাড়। অস্টিন থেকে একটু বাইরে গেলেই এই দৃশ্য দেখা যায়। আমাদের প্রথম গন্তব্য হচ্ছে টুয়েলভ এপোস্টেইল মেরিন ন্যাশানাল পার্ক।

টুয়েলভ এপোস্টেইল বাইবেল থেকে উঠে আসা নাম। যীশু খৃষ্টের বারোজন প্রধান শিষ্যের নামে এই মেরিন পার্ক। ১৯০০০ হাজার একরের এই পার্কের প্রধান দ্রষ্টব্য হচ্ছে সমুদ্রের ভেতর ফুঁড়ে আসা বারোটি স্তম্ভ। মিনিট তিরিশেক সেই টেক্সাসের মামাতো ভাই টাইপ রাস্তায় চলার পরেই নাটকীয় ভাবে দৃশ্যের পরিবর্তন হল। ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে সমুদ্রের নীল দেখা যেতে লাগলো।

আমারদের ছোট রাস্তাটা হঠাৎ করেই গিয়ে পড়ল সমুদ্রের ধার ঘেঁষে চলা এক রাস্তাতে। ডান দিকে সমুদ্রের গর্জন, কেমন হলদেটে বিস্ময়কর পাথুরে মাটি। দিনটা একদম ঝকঝকে, সমুদ্রের পানিটা গাঢ় নীল। রাস্তার বাম দিকে একটু পর পর ছোট ছোট শহর, প্রচুর গেস্ট হাউজ টাইপের বাড়ি, হোটেল ইত্যাদি। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর টুরিস্ট আসে এইখানে। রাস্তাতে সতর্কবাণীও আছে - অস্ট্রেলিয়াতে রাস্তায় গাড়ি বাম দিকে দিয়ে চলে, সুতরাং খুব খিয়াল কৈরা।অস্ট্রেলিয়ানরা গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে বামপন্থী। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আমারা প্রায়

সারাক্ষণ অস্বস্তি লাগছিল - আমরা উল্টো পথে চলছি কেন? এই সতর্কবাণী আমাদের মতো ডানপন্থী ড্রাইভারদের জন্য।

টুয়েলভ এপোস্টেইল বা বারো শিষ্যের পার্কে আমরা বেশ অনেকক্ষণ ছিলাম। চারিদিকে কেমন সমুদ্রের গর্জন, মানুষের ভিড়, ভেজা বাতাস, আকাশে উড়ছে সিগ্যাল, নীল সমুদ্রে সাদা ফেনা, হলদেটে লাইমস্টোনের পাথর। জীবনানন্দ হাজির হন অবেলাতেই।

"দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি

হে সিন্ধুসারস 

মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি

নাচিতেছ টারান্‌টেলা— রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি

চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায়

ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়।"

(সিন্ধুসারস)।

এখন দুই একটা ব্যাপার বলা দরকার।

আমি গুনে দেখেছি বারো শিষ্যের পার্কে বারোজন শিষ্য নেই। টুয়েলভ এপোস্টেইলের লাইমস্টোনের স্তম্ভ সমুদ্রের আঘাতে আস্তে আস্তে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। বারোশিষ্যের অনেকেই গত হয়েছেন সেই আগ্রাসী সমুদ্রের আক্রমণে। আপাতত ৮ জন অবশিষ্ট আছে। সর্বশেষজন ২০০৫ সালে গত হয়েছেন।

টুরিস্টদের মধ্যে চৈনিক মানুষের সংখ্যা প্রচুর। অনেক নির্দেশনাও চৈনিক ভাষাতে। অস্ট্রেলিয়ার সব শহরেই চৈনিক মানুষদের প্রাচুর্য দেখেছি আমি। চৈনিকরা পৃথিবীর নব্য ধনিক দেশ। তারা যে শুধু দলে দলে বেড়াতে আসে তা-না, মেলবোর্ন সহ অনেক বড় বড় শহরে বাড়ি ঘর, ব্যবসা ইত্যাদি কিনছে তারা।

বাথরুমে হারায়োগ্লিফে বর্ণনা করা আছে কিভাবে সঠিক নিয়ে বাথরুম ব্যবহার করতে হবে। কি ঘটছে এইখানে? দূর ভবিষ্যতের মানুষ হয়ত এইগুলো এনালাইসিস করবে, ঠিক আমরা যেমন গুহাচিত্র দেখে প্রাচীন মানুষের জীবনটা বুঝতে চাই।

হলুদ পাথরের ঝোপের ভেতরে প্রচুর বিষধর সাপ আছে। এই ব্যাপারে বারবার সতর্কবাণী দেওয়া আছে। এখন শীতকাল তাই সেই ভয় নেই। কয়েকমাস পরে আসলে এদের দেখা যাবে। একজন জানালো এইখানে সর্পদর্শন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

বারো শিষ্যের পার্ক থেকে পরের অংশের রাস্তাটা খুবই বৈচিত্রপূর্ণ। পাহাড়ি রাস্তা আছে, আছে মোটামুটি সাইজের একটা অরণ্য, হাহা করা খাদ আর নিচে সমুদ্রের উথাল পাথাল ঢেউ। কোথাও কোথাও রাস্তাটা বাধ্য ছেলের মতো সমুদ্রের একদম কোল ঘেঁষে একেবেঁকে চলে গেছে। রোদ চলে গিয়ে সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল, এরপরে আবার রোদ উঠেছে। দূর সমুদ্রের উপর একটা রংধনু আমাদের ধাওয়া করে চলছে অনেকক্ষণ। এই সমুদ্রের ওই পারেই আন্টার্টিকা মহাদেশ। আমরা হাঁ করে গিলে চলছি প্রকৃতির বৈচিত্র্য, আমাদের স্বাগত জানাতে তার আয়োজনে কোন ত্রুটি নেই।

প্রায় দিন শেষে বিকেলের রোদটা যখন লম্বা হয়ে এসেছে, তখন আমরা থামলাম লর্ন (Lorne) নামের একটা ছোট শহরে। গুগল বলেছে এই শহরের লোক সংখ্যা মাত্র ১১০০। রাস্তার পাশের সমুদ্রের ঠিক একটা পাশের পার্কে আমরা থামলাম। উদ্দেশ্য লেইট লাঞ্চ অথবা অগ্রিম রাতের খাবার - কিছু একটা। নেমেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম - যদি বেঁচে থাকি এই শহরে এসে একবার এক সপ্তাহ থাকবো, প্রতিদিন এসে এই পার্কে বসে থাকবো।

লর্নের কথা বলার একটা কারণ আছে। আমরা ফিশ এন্ড চিপস খেয়েছিলাম একটা দোকান থেকে। দোকানী আমাদের সামনেই একদম তাজা মাছ ভেজে দিলেন। মাছভাজাতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ কোন কম্পিটিশন থাকলে আমি এই লোকটাকে বলতাম সেখানে অংশগ্রহন করতে। এতো ভালো ফিশ এন্ড চিপস আমি কোথাও খাইনি আর। মাছভাজার পাশাপাশি দোকানী আমাদের সাথে সামান্য গল্পও করছিল। আমি টেক্সাস থেকে আসছি শুনে আমাকে জানালো আমি মেক্সিকান বিয়ার পছন্দ করি কিনা। তখন দেখলাম দোকানের ফ্রিজারের থরে থরে রাখা মেক্সিকান করোনা বিয়ার। সে জানালো তার দোকানে এটা নাকি অন্যতম বেস্ট সেলার।

থরে থরে সাজানো করোনা বিয়ারের বোতল দেখে আমি একটু হোমসিক বোধ করি। এই হোম ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে। আমি আছি অস্ট্রেলিয়াতে। বাংলাদেশের পরে আমার সবচেয়ে বেশি নিকটাত্মীয় থাকে অস্ট্রেলিয়াতেই। টেকনিক্যালি চিন্তা করলে আমার হোমসিক হওয়া উচিত না, পরিবারের সবাই কাছেই আছে। এরপরেও মনে হল এক সপ্তাহ আগেও টেক্সাসে ছিলাম, এই শনিবার বিকেলে গরমে ঘামতে ঘামতে পার্কে হাঁটছিলাম।

মাত্র ৫ দিন আগে ছেড়ে আসা অস্টিন শহরের জন্য মন কেমন করে উঠল, ঠিক যেমনটি মাঝে মাঝে করে ২২ বছর আগে ছেড়ে আসা আমার শহরটার জন্য। কোনটা নিজের শহর, কোনটা পরের শহর সেই প্রশ্নের সমাধা হয় নি, সম্ভবত কোনদিনও হবেও না। অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আসার পরে আমি মাঝে মাঝে সামান্য দেখা সেই দেশটাকেও মিস করি। "হোম" ব্যাপারটা আসলেই গোলমেলে...

যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে,

কোনখানে যে মন লুকানো দাও বলে ॥

চপল লীলা ছলনাভরে

বেদনখানি আড়াল করে,

যে বাণী তব হয় নি বলা নাও বলে ॥

ডাউনআন্ডার ২ঃ দক্ষিণের অজানা দেশ

রাত তিনটার সময়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল। জেটল্যাগ ব্যাপারটা অদ্ভুত। দূরদেশে গেলে বোঝা যায়। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েও টের পাওয়া গেল। একদিন হয়েছে মেলবোর্নে এসেছি। ঘুম থেকে উঠে শরীরটা একদম ঝরঝরে লাগছে, মানে সকালবেলার মতো। অথচ এখন অস্ট্রেলিয়া বা মার্কিন দেশ কোথাও সকাল বেলা না। সকাল হচ্ছে সম্ভবত প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি কোন জায়গাতে। জেটল্যাগ খতরনাক জিনিস, বিছানা শুয়ে থাকলে ঘুম আসবে না। আমি চা বানিয়ে খেতে খেতে বায়োলজিক্যাল ক্লক নিয়ে চিন্তা করি। আমাদের শরীরের ভেতরের ঘড়িটা জেটপ্লেনে ভ্রমনের জন্য তৈরি হয় নি। সেই কারণেই সে অস্ট্রেলিয়া আর মার্কিন দেশের মধ্যে কোথাও গিয়ে আটকে গেছে। জেটল্যাগ কাটানোর সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে সেটাকে ইগনোর করা। সেটাই করছি, জেটল্যাগ ঠিক করার চেষ্টা না করে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত হওয়াটাই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি। আর সেই পথ তৈরি করা আছে। পরদিনই, মানে শুক্রবার কাজের পরে আমরা দুই দিনের জন্য ঘুরতে বের হচ্ছি। আমাদের গন্তব্য হচ্ছে গ্রেট ওশান রোড। আমার ভায়রা ভাই সোহাগ সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। মধ্যরাতে উঠে আমি গ্রেট ওশান রোড সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ শুরু করলাম। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিন পূর্ব উপকূলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার রাস্তা। নাম শুনেই বোঝা যায় সেই রাস্তা মহাসমুদ্রের পাড় ঘেঁষে। অস্ট্রেলিয়ার পাশে দুটো মহাসমুদ্র, প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগর। ম্যাপ দেখে মনে হল গ্রেট ওশান রোড পুরটাই প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে। একশ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে যুদ্ধফেরত সৈন্যদের দিয়ে এই রাস্তা তৈরি করা হয়। এটা শুধু রাস্তাই নয়, সেই সঙ্গে পৃথিবীর দীর্ঘতম ওয়ার মেমরিয়ালও। শুক্রবার রাতে আমরা মেলবোর্ন থেকে রওনা দিয়ে ওয়ার্নাম্বুল নামের ছোট একটা শহরে থাকবো। মহাসমুদ্রের একদম ধার ঘেঁষে শহরটা। শনিবারে সেইখানেই ঘোরাঘুরি। রবিবার সকালে মেলবোর্নে ফিরব, কিন্তু ঘুরা পথে, গ্রেট ওশান রোড দিয়ে। 

আমি গ্রেট ওশান রোডের ছবি দেখতে থাকি। বহুকাল আগে সফটওয়ার ডিজাইন প্যাটার্ন নিয়ে একটু পড়াশুনা করেছিলাম। সফটওয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে লেখা কোডগুলো কতকগুলো প্যাটার্নে ভাগ করে ফেলা যায়। কোড নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাটি করলে ডিজাইন প্যাটার্ন ধরা যায়। সেই আলাপে যাচ্ছি না। তেমনি প্রকৃতিতে ডিজাইনেও কিছু কমন প্যাটার্ন দেখা যায়। সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলোতে মূলত এই জিনিসগুলোর কয়েকটা (বা সবগুলো) বিভিন্ন কম্বিনেশনে থাকে - সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল, নদী, হ্রদ, গিরিখাদ। কিন্তু প্রকৃতির ডিজাইনরা আমাদের অফিসের মোটা মোটা সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের মতো না। একই জিনিস তারা বিভিন্ন জায়গাতে এমনভাবে প্যাকেজ করেন যে ডিজাইন প্যাটার্ন কমন পড়লেও বিস্মিত হতে হবেই। কলোরাডোর পাহাড় আর বান্দরবানের পাহাড় এক জিনিস নয়, দুটোই সুন্দর কিন্তু সেই সৌন্দর্যে ভিন্নতা আছে। অনেকখানি ভিন্নতা তৈরি করে ভূপ্রকৃতি, পশুপাখি আর গাছপালা। কি আছে সেটা জানলেও প্রকৃতির সামনে দাঁড়ালে মুগ্ধ হতেই হয়!!! 

নিদির্ষ্ট সময়ে আমরা ওয়ার্নাম্বুলের পথে রওনা দিলাম।যাওয়ার সময়ে সরাসরি চলে যাবো, গ্রেট ওশান রোডে উঠব না। কেননা রাত্রিবেলাতে গাড়ি চালালে স্বর্গ আর নরকের পার্থক্য তেমন বোঝা যায় না। আমরা দুটো পরিবার যাচ্ছি, ৮ জন মানুষ। সোহাগ মানবপাচার করার সাইজের গাড়ি নিয়েছে। সাথে আরও একটি পরিবার যাচ্ছে, দিঠি আর তনয়। আমাদের পেছনে পেছনে ওরা আসবে ওদের গাড়ি চালিয়ে। পথে আমরা ফাস্টফুডের দোকান ম্যাকডোনাল্ডসে থামলাম। দুটো কারণে এই থামার কথা বলা। প্রথমত আমি অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ম্যাকডোনাল্ডসের আধিক্য দেখেছি। এটা এবং কেএফসি ছাড়া অন্য ফাস্টফুডের দোকান তেমন চোখে পড়ে নি। মার্কিন দেশে ম্যাকডোনাল্ডস ছাড়াও প্রচুর ফাস্টফুডের দোকান আছে।সেই সঙ্গে আছে বিস্তর মোটা মানুষ এবং শিশুকিশোর। অস্ট্রেলিয়ানরা ফাস্ট ফুড কম খায় কিনা, এটা গুগল করে পরস্পরবিরোধী তথ্য পেলাম।কিন্তু গুগল জানালো মোটা মানুষ অস্ট্রেলিয়াতেও আছে প্রচুর, প্রায় ৬৪% মানুষ ওভারওয়েট। সেটা থেকে মনে হল ম্যাকডোনাল্ডস একাই তার দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করে যাচ্ছে। যেইখানে পারছে না, সেইখানে কেএফসি দায়িত্ব নিচ্ছে। ম্যাকডোনাল্ডস থেকে বের হয়েই চোখে পড়ল একটা বিলবোর্ড। তাতে লেখা - মেইক অস্ট্রেলিয়া গ্রেট। বিলবোর্ডে আহাম্মক টাইপের একটা লোকের ছবি। দেখে মনে হলো পয়সাওয়ালা লোক, পলিটিক্সে নেমেছে। অল্প একটু গুগল করে সেটাই সত্য মনে হল। পয়সাওয়ালা আর আহাম্মক টাইপের লোক "মেইক সামথিং গ্রেট" টাইপের শ্লোগান নিয়ে আসলেই ইদানিং আমার আতংক লাগে।যেহেতু আমরা ঘরপোড়া গরু, মেইক, গ্রেট আর আহাম্মকদের কম্বিনেশন যে কি ভয়ানক সেটা জানি!!! 

আমরা বেশ রাতে ওয়ার্নাম্বুলে পৌঁছালাম। পথে সোহাগের গাড়ি স্পিড ক্যামেরাতে ধরা খেল। অস্ট্রেলিয়ার পথে প্রান্তরে লুকিয়ে আছে শত শত স্পিড ক্যামেরা। সাধারণত ক্যামেরার বসানো অংশের আগে একটা জেনেরিক ওয়ার্নিং দেওয়া থাকে - "সারা দেশে স্পিড ক্যামেরা আছে, বদ্দা আস্তে গাড়ি চালায়েন কইলাম"। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সোহাগ সেই আপ্তবাক্য অগ্রাহ্য করেছিল। স্পিডিং টিকেট বাসাতে পৌঁছে যাবে। যাত্রার শুরুতেই বিপত্তি!!!

যাই হোক এয়ারবিএনবি থেকে নেওয়া বাসাটা চমৎকার। দুই তলা। অনেকগুলো রুম। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে ঘর থেকে দুই কদম বের হলেই সমুদ্র। সামান্য গর্জনও কানে আসছে। আমরা দ্রুত খাবারের ইন্তেজাম করলাম। নানান ধরণের খাবার বানিয়ে আনা হয়েছিল। সেইগুলো গরম করে খাওয়া হল। রাতে আর্জেন্টিনার সাথে ফ্রান্সের খেলা।আমিই একমাত্র ব্রাজিল সমর্থক বাকিরা সবাই মেসিভক্ত আর্জেন্টিনা। এমন এক অবস্থায় মওদুদ আহমেদ স্টাইলে দল পরিবর্তন করে আর্জেন্টিনা সমর্থক গোষ্ঠিতে যোগ দেওয়াই ভালো। হাজার হোক আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল একই মহাদেশের দেশ। 

খেলা শুরুর আগে আমরা নানান জিনিস নিয়ে গল্প করলাম। আমরা মানে, সোহাগ, জিনিয়া, দিঠি, তনয়, মারিয়া আর আমি।তনয় আর দিঠিকে আমি জীবনে প্রথমবার দেখছি। জিনিয়ার (মারিয়ার ছোট বোন) সাথে দিঠি স্কুলে পড়ত। কবিতার বাইরে দিঠি শব্দটা আমি কোথাও শুনিনি। নামের মতোই চমৎকার মেয়েটা। গল্প শুরু করার পরে মনেই হল না যে ওদের সাথে আমার এই প্রথম দেখা। প্রবাসে বাংলাদেশিদের সাথে অনেক দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে যেতে পারে, নিজের ভাষায় কথা বলার একটা আনন্দ আছে, নিজের দেশের লোক পেলে সম্ভবত দেশের মাটির গন্ধটাও পাওয়া যায়। আমরা ঢাকার গল্প করলাম, টাইম ডাইলেশন নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হল, আর্জেন্টিনা অদ্য রজনী ফ্রান্সকে শুইয়ে ফেলবে এই বিষয়ে আমরা সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করলাম। আমি সেই সঙ্গে এটাও জানালাম যে আমি যেই দলকে (বা নির্বাচনের প্রার্থী) সমর্থন করি তারা সাধারণত হেরে যায়।

দুঃখের বিষয় আর্জেন্টিনা ওই রাতেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়ে নিল। কালান্তক জেটল্যাগের ঠেলাতে আমি খেলাটা পুরো দেখতে পারলাম না। পরদিন ভোরের সবার বিমর্ষ মুখ দেখে ভূয়া সাপোর্টার হয়েও আমারও খুব দুঃখ লাগলো আর্জেটিনার জন্য। আমার ধারণা ছিল জার্মানি বিদায় নেওয়ার পরে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার জন্য পথটা সুগম হয়েছে। এমনই এক দুঃসময়ে বারান্দার জানালা খুলে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একশ মিটার দূরেই প্রশান্ত মহাসাগর। একটু আগে বৃষ্টি শেষ হয়েছে। সকালের একটা নরম রোদ উঠব উঠব করছে। আর সমুদ্রের উপরে পুরোটা আকাশ জুড়ে আছে একটা জ্বলজলে রংধনু। এরপরে আর মন খারাপ করে থাকা চলে না। 

আমরা ওয়ার্নাম্বুলে ঘুরতে বের হলাম। যেহেতু গ্রেট ওশান রোড দিয়ে ফিরব, সেহেতু ওই পথে গেলাম না।ওয়ার্নাম্বুলের চারিদিকে ভূপ্রকৃতি খুব চমৎকার।একটু পাহাড়ি জায়গা, জঙ্গল আছে, তাতে এমু (Emu) ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনমনে। পাহাড়ি নদীও আছে, ছোট ঝর্নাও আছে। সম্ভবত ফার্মিং হয় প্রচুর। টিভিতে দেখা অস্ট্রলিয়ান গরুর দেখা পাওয়া গেল। গরু থাকলে আইসক্রিম আর চিজের ফ্যাক্টরি থাকে। দূর থেকে সেইগুলোও চোখে পড়ল। 

নিচের ছবিগুলো সব ওয়ার্নাম্বুল আর পোর্ট ফেয়ারি এলাকাতে তোলা। অস্ট্রেলিয়ার আকাশ যেমন ঝকঝকে নীল, তেমনি সমুদ্রের পানিও। যে কয়টি বিচে গেছি আমরা, সেগুলো প্রতিটিই খুবই পরিস্কার ছিল। নিচের ছবির সমুদ্রটা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর। আমাদের জানালার বাইরে যে জলরাশি, তার অন্য পাড়ে আছে আন্টার্টিকা মহাদেশে। সম্ভবত বাকি পৃথিবীর আবর্জনা নেই বলেই ওয়ার্নাম্বুলে দেখা সমুদ্রটাকে আমার অসাধারণ পরিস্কার মনে হয়েছে। আর পুরোটা দিনই রোদ আর হালকা বৃষ্টির লুকোচুরিতে কেটেছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল আমাদের সফর উপলক্ষ্যে সারাদিনই মনে হয় প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে একটা রংধনু ফিট করে রাখা আছে। আমাদের রংধনু ভাগ্য খুব ভালো বলতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার যেখানেই গেছি - সেখানেই রংধনু দেখেছি। 

প্রকৃতি আমাকে মুগ্ধ করে, মনে হয় বেঁচে থাকা সার্থক। প্রকৃতির ডিজাইন প্যাটার্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ!!! 


ডাউনআন্ডার ১ঃ দূরদেশ

প্রাচীন পৃথিবীতে নাকি সবগুলো মহাদেশ জোড়া লেগে ছিল। ছোটবেলাতে শুনেছিলাম, এটা নিয়ে কোন ঘাঁটাঘাটি করিনি কোনদিন। কেননা পৃথিবীর ম্যাপ দেখে আমার নিজেরও সেই রকম ধারণা হয়েছিল। মহাদেশগুলোর চেহারা কেমন যেন জিগ'স পাজলের মতো - দক্ষিণ আমেরিকা বেশ সুন্দরভাবে আফ্রিকার সাথে জোড়া লেগে যায়। একটু চাপাচাপি করলে অস্ট্রেলিয়ার উপরের অংশ বাংলাদেশের নিচে ফিট করানো যাবে। সেই প্রাচীন মহাদেশে হয়ত ঝালকাঠি থেকে সিএনজি নিয়েই অস্ট্রেলিয়ার ডারউইনে চলে যাওয়া যেত (আমি প্রাচীন মহাদেশগুলোর অবস্থান জানি না - এটা আমার বাল্যকালের ভাবনামাত্র)। মহাদেশগুলো যেমন একজন থেকে আরেকজন দূরে সরে গেছে তেমনি দূরে সরে গেছে মানুষগুলো। মাঝে সমুদ্র যেমন আছে, তেমনি আছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মের দেয়াল। আরও আছে সাদা মানুষ, কালো মানুষ, বাদামী মানুষ - আমাদের এই একমাত্র বাসস্থানকে আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে ভাগ করে ফেলেছি - ভৌগলিক দূরত্বের চেয়ে মানসিক আর আদর্শগত দূরত্ব অনেক বেশি দূরের পথ।

অস্ট্রেলিয়া অনেক দূরের দেশ, বিশেষত আমার বর্তমান বাসভূম থেকে পুরো একদিনের যাত্রাপথ। আমার বড়ভাই সেই মহাদেশে গত ২৩ বছর ধরে থাকেন। মারিয়ার বোনও প্রায় ১২ বছর ধরে সেই মহাদেশবাসী। বাঙালি মধ্যবিত্তকে জীবন আর জীবিকার জন্য আক্ষরিক অর্থেই সাগরপাড়ি দিতে হয়েছে। আমার বাবা জীবিকার জন্য ৫০ মাইল পাড়ি দিয়ে ঢাকা শহরে এসেছিলেন। আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে কয়েক হাজার মাইল। হয়ত একদিন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গ্রহান্তরে পাড়ি দিতে হবে।

অস্ট্রেলিয়াতে যাওয়ার ইচ্ছে অনেকদিনের। অস্ট্রেলিয়া আমার কাছে শুধুই একটা দেশ না। আমাদের পরিবারের একটা অংশ এই দেশেই বড় হচ্ছে। একশ বছর পরে এদের বংশধরেরা কেউ কাউকে চিনবে না। কিন্তু দেখাশোনা না হলে সেই ভবিতব্য ২০ বছর পরেই চলে আসবে। আমার ভাইয়ের সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে। তাদের শৈশবের সময়টাতে আমি ধারেকাছে কোথাও ছিলাম না। কারো শৈশবে অনুপস্থিত থাকলে কি তার বাকিটা জীবনের অংশ হওয়া যায়? কত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় নি।

যাই হোক, জুন মাসের ২৫ তারিখ রাতে সেই প্রতীক্ষিত ক্ষণ চলে এলো। রাত দশ'টায় আমরা কোয়ান্টাস এয়ারলাইন্সের বিমানে চেপে বসলাম। ডালাস থেকে সিডনি - সরাসরি বিমান। বছর দু'য়েক আগে এই ফ্লাইটটা ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম সরাসরি ফ্লাইট। প্রায় ১৭ ঘন্টার পথ। এর আগে ও পিছে ছোট দুটো ফ্লাইটও আছে। সব মিলিয়ে ২৪ ঘন্টার পথ।

কোয়ান্টাসের সার্ভিস চমৎকার। ঝকঝকে নতুন এয়ারবাস ৩৮০ বিমান। খাবারের মান ভালো। ইন ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট মন্দ না। কিন্তু ওয়াইফাই সুবিধা নেই। উঠার পরে লক্ষ্য করলাম বিমানে একজনও মহিলা কেবিন ক্রু নেই। সব পুরুষ মানুষ। এরা কি মদিনা সনদে প্লেন চালায়? খুব অল্প স্যাম্পল সাইজ থেকে বড় ডিসিশনে আসা উচিত না যদিও হরহামেশা আমরা তা-ই করি। এটা বলার মানে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াতে মাত্র একমাস থেকে সেই দেশ সম্বন্ধে কোন ধারণা করা ঠিক না। যদিও আমার লেখাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি সেটা করব, কেননা সেটাই আমজনতার চরিত্র। প্লেনে উঠে ডিনার শেষ করে, ইয়ং শেল্ডনের গোটা চারেক পর্ব দেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। কোন ঝাঁকুনি নেই, আরামদায়ক যাত্রা। প্রায় ৭/৮ ঘন্টা পরে ঘুম ভাঙলো। এইবার দেখলাম এক যাদুমন্ত্রবলে সব কেবিন ক্রু মহিলা। কোয়ান্টাসে নিশ্চয় প্রমীলা রাজ্য চলছে।

আমরা ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সময়ে মেলবোর্ন পৌঁছালাম। টেক্সাসে আমরা গরমে পুড়ছিলাম। ভূগোলের ষড়যন্ত্রে অস্ট্রেলিয়াতে এখন শীতকাল। বাইরে সকালের নরম রোদ। আকাশে মেঘ নেই। সামান্য একটা বাতাস আছে। আকাশ ঝকঝকে নীল। তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। মার্কিন দেশে তাপমাত্রা মাপা হয় ফারেনহাইট স্কেলে। আমি ১৬ কে ৫ দিয়ে ভাগ করলাম, এরপর ৯ দিয়ে গুন করে ৩২ যোগ করলাম। অংকে প্রথম দুইবার ভুল হল, তৃতীয়বার ঠিক ঠাক বের করতে পারলাম। মোটামুটি আরামদায়ক শীত। 

আন্তজার্তিক তারিখ রেখা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অতিক্রম করার কারণে আমার জীবন থেকে ২৬শে জুনটা হারিয়ে গেছে। ২৫ থেকে একদিন ভ্রমণ করে আমি ২৭শে জুনে এসে পড়েছি। আমি ভূগোলের চক্রান্ত নিয়ে ভাবি, সেন্টিগ্রেড আর ফারেনহাইট স্কেল নিয়ে ভাবি, মেলবোর্নের রাস্তা দেখি আর মনে হয় গাড়িগুলো সব রং সাইড দিয়ে চলছে।

আমরা কর্কট ক্রান্তি, বিষুবরেখা, মকর ক্রান্তি আর আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা সব কিছু পাড়ি দিয়েছি। ক্লান্ত লাগা উচিত। কিন্তু লাগছে না। প্রিয়জনের মুখ দেখলে ক্লান্তি লোপ পায়, বাইরে নরম সূর্যের আলো বিরক্তি শুষে নেয়। ঝকঝকে নীল আকাশ দেখলে মনে ভালো লাগা ভিড় করে। আজকে সব কিছু একসাথে আছে। কী চমৎকার একটা দিন!!!

যাক অবশেষে অস্ট্রেলিয়াতে আসা গেল।

যোগ বিয়োগ

দুই মেয়েকেই আমি অংক করাতাম। অনেকের ধারণা প্রকৌশলীরা অংকে ভালো। ব্যাপারটা পুরো সত্য না। আমি উচ্চতর গণিতের প্রায় পুরোটাই ভুলে গেছি কেননা বুয়েটের অংক পরীক্ষা আসলে মুখস্থ বিদ্যা ছিল। আমার জ্ঞান সুদকষা পর্যন্ত, স্কুলে স্যারেরা ভালো অংক শিখাতেন, ওটা টুকটাক পারি।

যাই হোক বড় মেয়ে নিরীহ গোছের। আমি যা পড়াই সেটা সে মেনে নেয়। সে তখন ক্লাস টু-তে পড়ে। একদিন বিরাট একটা প্রজেক্ট নিয়ে হাজির। লাইফ স্টাইল এনালাইসিস বা এই জাতীয় গালভরা নাম। বিরাট আলোচনা, কিন্তু প্রজেক্টে মূলত দুটি অংশ আছে। একদিকের অংশে প্রচুর প্রশ্ন, কী রকম জীবন চায় সে?
আমরা প্রজেক্ট নিয়ে বসলাম। প্রথমেই বাড়ি - নানান ধরণের বাড়ি আছে। সাদামাটা বাড়িও আছে, পাহাড়ের চূড়ার বাড়িও আছে যেটার জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। আনুশা সেই রকম বাড়িই নিল।
এরপরে আসলো গাড়ি। পাহাড়ের চূড়াতে যে থাকে, তার পক্ষে আমার মতো পুরনো হোন্ডা গাড়ি চালানো শোভা পায় না। আমরা দেখে শুনে একটা ল্যাম্বরগিনি নিলাম।
আনুশার নজর উঁচু, সে বছরে তিনটা ভ্যাকেশন নিবে, একদিন জাপান তো একদিন ব্যক্তিগত ইয়টে চড়ে সমুদ্রে একটু হাওয়া খেয়ে আসবে। খুব মনোযোগের সাথে সে খুব আনন্দ নিয়েই পছন্দের জীবনটা বেছে নিলো।
প্রতিটি চয়েজের সাথেই একটা ডলারের অংক ছিল। জীবনধারা ঠিক করার পরে সেই অংকগুলো যোগ করতে হবে। একটু চেষ্টা টেষ্টা করে আমরা সেগুলো যোগ করলাম। ক্যালকুলেটর জানালো যে যোগে ভুল হয় নি।
এবার অন্যদিকের অংশে নজর দেওয়া হল। সেটা হচ্ছে পেশার অংশ। মানে একেকটা পেশার নাম, সাথে সেই পেশার আয়ের পরিমাণ। এখানে আনুশার বেশি চিন্তা করতে হলো না। আনুশা স্কুলের মাস্টার হতে চায়। স্টক ব্রোকার, বিজনেস এক্সিকিউটিভ, ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, হাইটেকের সিটিও এইগুলো সে খারিজ করে দিলো।
গোল বাঁধলো এইখানেই। আয়ের কলামের সাথে ব্যয়ের কলামের বিস্তর তফাত। স্বপ্নের জীবন আর স্বপ্নের পেশার মধ্যে যোজন যোজন তফাত। স্কুল মাস্টারের আয় দিয়ে সে যে জীবন চাইছে তা অধরাই থেকে যাবে।
জীবনের শুরুতেই ভীষণ দাগা খেয়ে গেল মেয়ে। সে জানালো এই রকম পরিস্থিতিতে সে কি ব্যাংক থেকে টাকা আনতে পারবে কিনা।
আমি আনুশাকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাংক কেন টাকা দিবে তাকে?
আনুশা জানালো ব্যাংক টাকা নিয়ে বসে থাকে মানুষকে সাহায্যের জন্য। যখনই কারো পকেট খালি হয়ে যায় তখনই একটা এটিএম মেশিনে কার্ড ঢুকালে ব্যাংক তাকে টাকা দেয়। আমি মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে এটিএম মেশিন থেকে টাকা তুলি, এরপরে মানিব্যাগটা একটু স্ফিত হয়ে যায়। যেটুকু সে দেখেছে তাতে তার ব্যাংককে মোটামুটি মহামানব মনে হয়েছে।
চূড়ান্ত আঘাত করতে বাধ্য হলাম। ব্যাংকের কাজকর্ম শুনে আনুশা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। আমার টাকাই ব্যাংক আমাকে দেয়, এবং সেই অর্থ উপার্জনের জন্য আমাকে দিনরাত কাজ করতে হয়।
আমি কাজ করছি, উপার্জন করছি, খরচ করছি - এর মধ্যে ব্যাংকের ভূমিকাটা কী? যেই টাকা আমার পকেটে থাকার কথা সেটা কেন ব্যাংক তার উদরে রেখে দিবে?
সব শুনে টুনে আনুশা এক কথায় ব্যাংকিং খাতকে নাকচ করে দিলো।
ইট'স নট ফেয়ার, নট ফেয়ার এট এল। ব্যাংকের উচিত সবাইকে টাকা দেওয়া। আই থিংক দে আর মিন পিপল।
বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ মোটামুটি সত্য। তবে কারো কারো জন্য ব্যাংক বেশ উদার। তারা চাইলেই টাকা পায় বটে। ব্যাংক ডাকাতি হতো বন্দুক নিয়ে, এখন বাংলাদেশে দেখি অনেকের জন্যই আনুশার স্বপ্নের ব্যাংক বসে গেছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে দেখি অনেকেই বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে আসছে ব্যাংক থেকে।
"ডু ইউ হ্যাভ টু ডু দিস ম্যাথ হোয়েন ইউ গ্রো আপ?"
নিদারুণ এক সত্যের মুখোমুখি হয়ে গেলাম আমরা। ক্লাস টু-এর বাচ্চাদের জন্য যে এই প্রজেক্টটা তৈরি করেছেন তাদের ব্যাপারে আমার প্রতিক্রিয়া মিশ্র। এই প্রজেক্টটি আসলে প্রজেক্ট নয়, বরং এটা লাইফ লেসন। আমেরিকাতে বহু বহু মানুষ ক্লাস টু পাশ করলেও এই প্রজেক্টের মূল বক্তব্য তারা ধরতে পারেনি। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের ফাঁদ পেতে রেখেছে। সেই ফাঁদে পা দিলে একবারে ঘরের চাল হারানোর মতো পরিস্থিতি হতে পারে। আমার মনে হয় এই প্রজেক্টটা রিটায়ার করার আগে পর্যন্ত প্রতি বছরই একবার করা উচিত। কিন্তু একই সঙ্গে সাত বছরের মেয়ের আনন্দময় জগতটাকে আয় আর ব্যয় দিয়ে খান খান করে দেওয়ার জন্য সেই পাপিষ্ঠদের ধিক্কার।
মানুষকে এক সময়ে বড় হতে হয়। রূপকথার বাইরে গিয়ে বিশাল পৃথিবীতে ডানা মেলতে হয়। জীবনের একটি অন্যতম অধ্যায় হচ্ছে আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করা। পৃথিবী জুড়ে সবর্ত্রই মানুষ এই অংকে এসে আটকে যাচ্ছে, অনেক সময়ে ইচ্ছেতে, অনেক সময়ে নিরুপায় হয়ে। বড়দের পৃথিবীটা আসলে একটা ফাঁদের মতো, আনন্দ আর সুখের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে প্রলোভনের হাতছানি অথবা অপ্রত্যাশিত অর্থ কষ্ট। যোগ আর বিয়োগ আসলে সবচেয়ে জটিল অংক।
আমি নিজেও পরিপক্ক নই এই খেলাতে। আমিও তাই চাই নি, বড় হতে, এই যোগ বিয়োগের খেলা আমার ভালো লাগে না। এরচেয়ে ফুরিয়র ট্র্যান্সফরমেশন অনেক সহজ, ল্যাপ্লাস ট্র্যান্সফর্মেশনও অত পিলে চমকানো না। কিন্তু বড়দের মূলত যোগ বিয়োগই করতে হয় সারাদিন। ব্যাপারটা দুঃখজনক।
সময়ের চক্রান্তে বড় হয়ে গিয়েছি আমরা, একদম নট ফেয়ার এটা, একদমই নট ফেয়ার!!!

আনুশার ১৫ বছরের জন্মদিনে

 আনুশার জন্ম নেওয়ার কথা ছিল মার্চ মাসের ৮ তারিখে। কিন্তু আমাদেরকে ৫ ই মার্চ ভোর রাতেই হাসপাতালে যেতে হল। আমরা অবশ্য প্রস্তুত ছিল। মানবশিশুর জন্মের প্রক্রিয়াটা সহজ নয়। বহু কষ্টের পরে আনুশা ভূমিষ্ঠ হল রাত ১২টা ৪৩ মিনিটে। ততক্ষণে মার্চ মাসের ছয় তারিখ শুরু হয়ে গেছে। আনুশার জন্মের পরের আমার আনন্দের পাশাপাশি বিশাল একটি অনুভূতি ছিল – বিস্ময়!!! এই ছোট বাচ্চাটা আমাদের!!! আমি বিস্ময় নিয়ে অনেকক্ষণ আনুশার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আনুশার সাথে সাথে আমিও জন্ম নিলাম পিতা হিসাবে। 

ছোট্ট আনুশা একবার "নো প্লেস ফর হেট" এর এম্বাসেডর হয়েছিল। ওর টিচার আমাকে জানিয়েছিলেন ক্লাসের যেসব বাচ্চাদের সাথে কেউ খেলতে চায় না, আনুশা তাদেরকে ডেকে খেলাতে নেয়। আমি আনন্দিত হয়েছিলাম কিন্তু ঠিক বিস্মিত হই নি, কেননা আনুশার পৃথিবীটা ম্যাজিকাল ছিল, সেখানে ঘৃণার অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু আমরা যেই পৃথিবীতে বাস করি সেটা মোটেও ম্যাজিকাল না, সবাইকে একদিন ধরাধমে নামতে হয়। আনুশাকেও জানতে হয়েছে যে এই পৃথিবীতে দুঃখ, শোক, বিষাদ সবই আছে। 

কিছুদিন আগে আনুশা জানালো সে বড়লোক হতে চায়। জেফ বেজোসের মতো বড়লোক। আমি কিছুটা দমে গেলাম। ছোট আনুশা চাইতো জেন গুডাল হতে। মিনমিন করে বেজোসের নামে কিছু বদনাম করলাম। তাতে খুব লাভ হল না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, ঠিক আছে - বেজোসের মতো বড়লোক হলেও চলবে - এমাজন থেকে গুডালের তহবিলেও টাকা যায়। 

বড় হওয়ার মজাটাই এটা। নিজের মতো একটা জীবন যাপন করা যায়।

একেকটা ধাপ পেরিয়ে যাচ্ছে আনুশা, আর নিত্য নতুন একটা আনুশাকে আমি দেখছি। নিত্যনতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি। 

ছোট্ট আনুশা জিজ্ঞেস করত – প্রজাপতি কি পাখি? 

মাঝারি আনুশা জিজ্ঞেস করত – পিটারপ্যান কি রিয়েল? 

একটু বড় আনুশা জিজ্ঞেস করে - কেন মানুষকে শরণার্থী হতে হয়? 

আনুশার বেড়ে উঠার সব ধাপেই আমি উপস্থিত আছি। ওর প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন থেকে স্কুলের নাটকের অভিনয়ে - দায়িত্ব থেকে না, আনন্দ নিয়েই আমি থাকতে চাই ওর জীবনের প্রতিটি ধাপে। 

আজ আনুশার ১৫ বছর পূর্ণ হল। ঠিক ১৫ বছর আগের মার্চ মাসের ছয় তারিখ রাত ১২টা ৪৩ মিনিটে আমার যেই বিস্ময়টা হয়েছিল, ১৫ বছর পরেও সেটা একটুও ফিকে হয় নি। 

আমি এখনও আমার মেয়েটার মুখের দিকে সেই বিস্ময় নিয়েই তাকিয়ে থাকি। 

শুভ জন্মদিন আমার ছোট্ট পাখি। শুভ জন্মদিন।

স্বৈরতন্ত্র

 আজকে বাচ্চাদের স্কুল থেকে তুলতে গিয়েছিলাম। আমার অরিজিনাল ডিউটি ছিল না এটা, কিন্তু হঠাৎ প্রয়োজন হওয়াতে যেতে হল।

নিজের দুই বাচ্চা + প্রতিবেশির একজন, সব মিলিয়ে তিনজনকে তুলতে হবে। ওদের উঠানোর সাথে সাথে ওরা সমস্বরে বলল, উই আর হাংগ্রি।

আমি পিৎসা নিতে চাইলাম। কেউ রাজী হলো না। এরপরে ফ্রাইড রাইসের কথা বললাম, নাকচ হয়ে গেল। এরপর ওদের সাজেশন চাইলাম।

দুইজন জানালো যে সাবওয়েতে স্যান্ডুউইচ খেতে চায়। ছোট মেয়ে রাজি হলো না। বাকি দুইজন বলল যে এটা ডেমোক্রেসি, সুতরাং ওকে মেজরিটির মতামত মানতে হবে। ছোট মেয়ে ডেমোক্রেসি যে কতখানি খারাপ সেটা নিয়ে ফোঁসফোঁস করল কিছুক্ষণ। 

সাবওয়েতে বসে আমরা বিভিন্ন তন্ত্র নিয়ে আলোচনা করলাম। 

কঠিন সমাজতন্ত্র হলে শহরে হয়তো একটাই খাবারের দোকান থাকতো, কোন চয়েজ থাকতো না। সেইখানেই খেতে হতো। সবাই একই সঙ্গে এটা "নট ফেয়ার" বলে নাকচ করে দিল। 

স্বৈরতন্ত্র থাকলে যার গায়ের জোর বেশি তার কথাই শুনতে হতো। একজনের কথাতেই সিদ্ধান্ত নিতে হতো। 

আশ্চর্যের ব্যাপার বাচ্চারা সবাই স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিল, অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবার মালিক হতে হবে সেই ক্ষেত্রে। আমি দেখেছি এই দুনিয়াতে সবচেয়ে সৎ জবাবটা বাচ্চারাই দেয়। 

আমার সারাজীবন ক্ষীণ ধারনা ছিল যে মানুষ আদতে স্বৈরাচারী প্রাণী। সেই সন্দেহ আরও ঘোরতর হলো। এই দোষটা আমাদের নয়, প্রকৃতিই আমাদের জোর যার মুল্লুক তার নিয়মে তৈরি করেছে। সমাজতন্ত্র সম্ভবত আমাদের জেনেটিক কোড থেকে বহুদূরে অবস্থিত একটা তাত্ত্বিক ধারণা। ঠিক মতো ঠেলা মেরে একে ফেল মারায়ে দাওয়া যায়। 

আমরা যে শুধু জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে দেশ চালাই সেটা না। আমাদের চেতনার মূলেও সেই একই মন্ত্র। আমরা সবাই নিজের মতটাই সঠিক মনে করি। গণতন্ত্রে ভিন্নমতের প্রকাশ-টকাশ ইত্যাদি ব্যাপার থাকলেও আমরা চাই আমাদের বিশ্বাসের মাপে যুক্তি সাজাতে। 

গতকাল ফরহাদ মাজহারের লেখা পড়ছিলাম। পিয়াস করিম বিষয়ক। তিনি বলেছেন পিয়াস করিম বেকুব মার্ক্সবাদী না। সুতরাং তিনি অলীক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে না। যেই দেশে যেই আচার, কাছা তুলে নদী পার। বাংলাদেশে মার্ক্সকে খাওয়াতে গেলে প্রথম তাঁর মুসলমানি করা দরকার। একমাত্র বিজ্ঞ মার্ক্সবাদী হ্যাজামই সেই কাজ করতে পারে। জাতি অসময়ে এক হ্যাজামকে হারালো। 

সেই সঙ্গে আমি গতকালের আগে পর্যন্ত জানতাম না যে কার্ল মার্ক্স এতো বড় একজন কামেল হুজুর। 

প্রকৃতির নিয়মে আমিও মোটামুটি স্বৈরাচারি মানুষ। লেখাটা পড়ে মোটামুটি জোরেই বলে ফেললাম...

চু**************

স্বৈরাচার নিপাত যাক - গণতন্ত্র মুক্তি পাক - এই শ্লোগানটা আসলে সত্য না, বুঝতে বুঝতে দিন চলে গেছে অনেক। 

সামারার ১৪ বছরের জন্মদিনে

- ১ - 

সামারা তখন একদম ছোট। বয়েস এক বছর হবে খুব বেশি হলে। আনুশা প্রায় তিন বছর। রাতে আমরা সবাই একসাথে শুই। ভূমিতে তোষক পেতে, এতো বড় বিছানা নেই কোথাও। আনুশা আমার এক পাশে, সামারা একটু দূরে ওর মায়ের সাথে। ঘুমানোর আগে আনুশা আমার গা ঘেঁষে এসে বলতো - আব্বু আমি তোমার বুকে শুবো। 

এর অর্থ হচ্ছে ওকে বগলদাবা করে আমার শুতে হবে। এতে ডাবল লাভ, আনুশার যেমন ঘুম আসে তেমনি আমিও খুব সহজেই নিদ্রাদেবীর আশীর্বাদ পাই। এমনি একদিন হঠাৎ সামারা বলে উঠল – আব্বু আমি তোমার বুকে শুব। সামারা কথা শুরু করেছে অতি দ্রুতই। এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ছোট ছোট বাক্য বলা শুরু করেছে। তার ভাষা শেখার গুরু তার বোন। সে গুরুমারা বিদ্যায় অভ্যস্ত। সে এটা বলেই তার মা-কে ডিঙ্গিয়ে আমার বগলদাবা হয়ে শুয়ে পড়ে। 


সেই থেকে শুরু। অনেকদিন আক্ষরিক অর্থেই আমি দুই মেয়েকে ঘুম পাড়িয়েছি এবং একই সঙ্গে নিজেও ঘুমিয়েছি। আনুশা একদিন বড় হয়ে গেল। সামারা অনেকদিন আমার সাথে লেগে ছিল। কিন্তু সব ভালোকেই এক সময়ে ছেড়ে দিতে হয়। সেও একদিন নিজের ঘর গুছিয়ে বসল। আইকিয়া থেকে পছন্দ করে আসবাব নিয়ে আসলো। আসলো বাহারি বাতি, হাতে উঠে এলো মুঠোফোন, কানে ইয়ার পড নামের এক বিচিত্র জিনিস। শেষ পর্যন্ত সামারাকেও আমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলা, আক্ষরিক এবং অক্ষরহীন – উভয় অর্থেই সামারার দরজা বন্ধ হয়ে গেল আমার জন্য। 

আমি সত্যি সত্যি একা হয়ে গেলাম। 

- ২ -

বড় হওয়াটা অবশ্যই আনন্দের। বিশেষত সামারার জন্য। সে একরোখা, জেদী মেয়ে। তাকে কিছু করতে বললে - হোয়াই আই হ্যাভ টু ডু ইট? কোথায় যেতে বললে - হোয়াই আই হ্যাভ টু গো? প্রতিটি ব্যাপারেই তার প্রশ্ন, এবং সেই সঙ্গে স্যারকাজামের ধাক্কা। 

সকালে ঘুম থেকে নিজে এলার্ম দিয়ে উঠে, রেডি হয়ে নিজেই নাস্তা বানিয়ে খেয়ে নেয়। এরপরে বিড়ালের দেখভাল করে নিজের কাজ শুরু করে। আমাদের কিছুই বলতে হয় না। প্রতিটি ব্যাপারে তার মতামত আছে। 

আব্বু ইউ ক্যান নট চেঞ্জ লরেল'স নেইম। ইট উইল হার্ট হার ফিলিং। 

বিড়ালটাকে বাড়িতে আনার পরে আমি তার নাম – আইনস্টাইন, নিউটন, ব্রুনো বা স্যাগান – কোন এক মহামানবের নাম দিবো ভেবেছিলাম। কিন্তু সামারার জন্য দেওয়া গেল না। 

“শি ডাজ নট নো হার নেইম, লরেল নামটা শেল্টার থেকে দেওয়া, ওরা এ, বি সি ডি - এই সিরিয়ালে নাম দেয়" 

"হাউ ডু ইউ নো ইট? ইউ ডোন্ট ওয়ার্ক দেয়ার" 

মানুষ ছাড়া আর প্রতিটি প্রাণীর ফিলিং এর ব্যাপারে সামারা খুব সচেতন। খুব সচেতন পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে। একদিন জানা গেলে স্কুলে অংক পরীক্ষাতে মিস বেশি নম্বর দিয়েছিল ভুল করে, সে নম্বর কমিয়ে এনেছে। প্রতিটি ব্যাপারেই তার যুক্তি আছে। 

আমি একদিন বললাম – আমার মনে হয় না এই সামারাই সেই সামারা যে আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতো না। আমি অফিসে গেলে আমার জামা পরে বসে থাকতো যে মেয়েটা, সেই মেয়েটা এটা নয়। 

সামারা জানালো উল্টোটাও পসিবল, হয়ত আমাকেই কেউ বদলায়ে দিয়েছে। 

সেটাও হতে, পারে - জীবনের পরমার্থই হচ্ছে বদলে যাওয়া। 

- ৩-

আর একটু পরেই সামারার বয়েস ১৪ হয়ে যাবে। সে আনন্দে আছে, সামনের বছর গাড়ি চালানো শিখবে, সব ঠিক থাকলে পরের ইলেকশনে হয়ত ভোট দিতে পারবে। রাজনৈতিক দর্শনে সামারার অবস্থান অনেকখানি বামদিকে। সেখান থেকে সে আমাকে প্রতিক্রিয়াশীল ডান ভেবে বসে মাঝে মাঝে। আমিও মেনে নিয়েছি জীবনের অবধারিত সত্য। সন্তানের ধনুক থেকে ছুড়ে দেওয়া তীরের মতো - তাদের যাত্রা পশ্চাতে নয়, ওরা আর বুকের মধ্যে শুতে চাবে না। বাসায় ফিরলে আর হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে আসবে না। ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করবে না - হু ডু ইউ লাভ মোস্ট ইন দিজ হোল ওয়াইড ওয়ার্ল্ড? অনন্ত আকাশ যার সামনে, সেকি কখনও পেছনে ফিরে চায়? 


শুভ জন্মদিন সামারা। শুভ জন্মদিন। সেই আকাশ স্পর্শ কর।  

Wednesday, December 23, 2020

সবুজ রঙের মানুষ

একবার চুল কাটতে গিয়েছিলাম। সাথে বাচ্চারা ছিল। মাথায় খুব বেশি চুল অবশিষ্ট নেই, কিন্তু যেটুকু আছে সেটার বৃদ্ধির গতি খুব বিরক্তিকর রকম দ্রুত। প্ল্যান করলাম সব চুল কেটে ফেলে দিব। ঝামেলা রাখতে নেই। নাপিতকে সেই প্ল্যান জানানোর পরে সে দ্রুত সাইজ জিরো ক্লিপ দিতে কয়েক মিনিটের মধ্যে কাজ সেরে ফেলল। কিন্তু ঝামেলা শুরু হল এর পরে। আনুশা ডাক ছেড়ে কান্না শুরু করল। সে একদম ছোট বাচ্চা নয়। ক্লাস টু বা থ্রি-তে পড়ে। কান্নার কারণ হচ্ছে আমার চেহারা পাল্টে গেছে। কান্নার মূল বক্তব্য হচ্ছে - আই ওয়ান্ট মাই ওল্ড ড্যাডি ব্যাক। আমার সাথে আমার এক বন্ধু ছিল, সে আর মারিয়া মিলে ঠাণ্ডা করল আনুশাকে। সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে তার “নতুন” বাবা নিয়ে বাসাতে আসলো। আমি আশ্বাস দিলাম যে দেখতে সামান্য অন্যরকম হলেও আমি সেই পুরনো বাবাই। এটা কয়েক বছর আগে ঘটনা। খুব রিসেন্টলি ওজন কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। এই বার সামারা বাঁধা দিচ্ছে, ওজন কমলে আমি দেখতে অন্যরকম হয়ে যাবো। তারও একই দাবী – সে চায় তার বাবা একই রকম থাকুক।

আমার প্রবাস জীবন ২২ বছরের বেশি হয়ে গেছে। প্রতিবার যখন দেশে যাই তখন দেশের যে ছবি দেখি সেগুলোকে চলচ্চিত্র না বলে স্ন্যাপশট বলা উচিত। প্রতিবারই মনে হয় ঢাকা শহর আগেরবারের চেয়ে একটু মলিন, একটু ধূসর হয়ে গেছে। প্রতিবারই মনে হত আব্বা আরেকটু বুড়ো হয়ে গেছেন। আমরা সবাই চাই আমাদের প্রিয় জায়গাগুলো ঠিকঠাক থাকুক একদম আগের মতো। প্রিয় মুখগুলোও থাকুক অমলিন, কালের চিহ্নমুক্ত। ২০১৩ সালে আম্মা মারা যাওয়ার পর দুই বছরে তিন বার দেশে গিয়েছি। প্রতিবার দেখা নতুন স্ন্যাপশটগুলো খুবই কষ্টকর – আব্বা হঠাৎ করে চলৎশক্তি হারিয়ে ফেললেন, আস্তে আস্তে নির্বাক হয়ে গেলেন, তাঁকে অন্য মানুষ খাইয়ে দেয়। কিছুদিন পরে সেটাও সম্ভব হল না, তাঁকে ফিডিং পাইপ দিয়ে খাওয়াতে হয়। তিনি নির্বাক চেয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে একটু হাসি দেন, অনেকদিন পরে অল্প পরিচিত মানুষকে দেখলে যে হাসিটা ঠোঁটের কোনাতে আসে, ঠিক সেই হাসি। আমাকে চিনতে পেরেছেন কিনা সেটা সেই হাসি থেকে বোঝা যায় না। ফিডিং টিউব পাল্টানোর সময় যন্ত্রণাতে ছটফট করতে করতে চিৎকার করেন। পিঠে বেড সোরের ক্ষত। আমি যদি ক্লাস থ্রিতে পড়তাম আনুশার মতো – আমিও চিৎকার করে কাঁদতাম,  আই ওয়ান মাই ওল্ড ড্যাডি ব্যাক।

আমার সেই “ওল্ড ড্যাডি” মোটেই এই রকম ভেঙ্গে যাওয়া মানুষ ছিলেন না। ভোর পাঁচটাতে তিনি দিন শুরু করতেন, অফিস করতেন, বাজার করতেন, বাগান করতেন, ব্যাঙ্কে গিয়ে বিল দিতেন, বাসার হাজারটা টুকটাক জিনিস করতেন নিঃশব্দে। বিছানায় নিঃসাড় তাঁকে আমি পড়ে থাকতে দেখিনি। সময় এসে কেড়ে নিয়ে গেছে তাঁকে। আমি আমার বাবার ৪৬ তম জন্মদিনে জন্মগ্রহন করেছিলাম। আমার ছেচল্লিশ বছর হওয়ার ঠিক পাঁচদিন আগে, দুই বছর আগের এই নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ তিনি অন্যভুবনে চলে যান চুপচাপ – তাঁর প্রস্থান ছিল পুরো জীবনের মতোই নিভৃত, নিঃশব্দ।

তাঁর জীবনের শেষের দুই বছরের স্মৃতিগুলো আমি জমিয়ে রাখতে চাই না। জীবন উদযাপন করার জিনিস, কষ্ট মনে রাখার নয়। তাই আমার স্মৃতিকোষে যেই বাবা আছেন তিনি একজন সতেজ, সবুজ মানুষ। সকালে ব্যস্ত হয়ে অফিসে যান, বিকেলে বাগানে গাছের পরিচর্যা। বিশ্বাস করেন "সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং" এর মতো প্রায় ভুলে যাওয়া জীবন দর্শনে। গাছ কেটে ফেললে মনে কষ্ট পান, অকারণে প্রাণী হত্যা করতে নিষেধ করেন।

আশির দশকে তোলা আব্বার কিছু ছবি আমার সংগ্রহে আছে। ছবির এই মানুষটাই আমার বাবা, আমার ছেলেবেলার বাবা, কৈশোরের বাবা, বড়বেলার বাবা। তিনি আমার বৃদ্ধকালের বাবাও হবেন যতদিন না পর্যন্ত স্মৃতিহীনতা এসে হানা না দেয়।

ভালো থাকুন আমাদের সবুজ রঙের বাবা।



৪৮ নট আউট

লেখাটা হঠাৎই খুঁজে পেলাম। আমার নিজের ভাঙ্গাচোরা একটা ব্যক্তিগত ব্লগ আছে। বহু বছর আগে তৈরি করেছিলাম। জীবনানন্দ দাশের অনুপ্রেরণাতে নাম দিয়েছিলাম ধূসর পাণ্ডুলিপি। নামকরণ সার্থক হয়ে গেছে। সেই পাণ্ডুলিপি এমনই ধূসর আর ধূলিময় হয়ে গেছে যে সেখানে আমার নিজেরই পদচিহ্ন পড়েনি গত কয়েক বছর।

এই লেখাটি আমার চল্লিশ বছরের জন্মদিনে লিখেছিলাম। আমার ব্যক্তিগত ধূসর ব্লগে। ঠিক আট বছর আগে। আট বছর, কুড়ি বছর - এইগুলো কাব্যিক মাইলস্টোন সময়। আট বছরে অনেক কিছু পাল্টেছে, সেই দিন যে ১০ বছরের কিশোর ছিল সে আজকে পূর্ণ যুবক। সময় কি আশ্চর্য বাহন, কী দ্রুতই সে চারিপাশের চেনা চিত্র পাল্টে দিতে পারে। নিচের লেখাটাও সামান্য আঁচড় দিয়ে একটু পাল্টে নতুন মোড়কে চালিয়ে দিচ্ছি।

বার্ধক্যের সাথে আপনার নিজের বয়সের যোগসূত্র আছে কোথাও। সেদিন এক আড্ডায় বলে বসলাম..বাবলু ভাই, উনিতো ইয়াং লোক আমাদের কয়েক বছরের সিনিয়ার, বয়স মাত্র ৪৬। বন্ধুরাও সায় দিল তাতে। আমাদের বয়স যত বাড়ছে, তারুণ্যের সিলিং ততই বেড়ে যাচ্ছে। চল্লিশে এসে এখন মনে হয় ষাট পর্যন্ত মানুষ ছোকরা থেকে যায়। আর ত্রিশ বছর বেচে থাকলে হয়ত নব্বুইকেও যুবক যুবক লাগবে। মনে মনে কেউ নিজেকে বুড়ো ভাবে না বোধহয়।

ক্লাসে টু'তে যখন শুনলাম সাত্তার স্যারের বয়েস ত্রিশ তখন রীতিমত বুড়ো লোক মনে হয়েছিল তাঁকে। এখন নিজের বয়স প্রতি বছর একটু একটু করে বাড়ছে, কমার নাম মাত্র নেই। বিশ বছর আগে যেসব মেয়েদের সাথে টাঙ্কি এবং ইয়ার্কির সম্পর্ক ছিল তারা সবাই বতর্মানে খালাম্মা বলে সম্বোধিত এবং জীবন নিয়ে দারুন ব্যস্ত, অনেকের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানও আছে। আমরাও পুত্র কন্যা নিয়ে ব্যস্ত; আমাদেরকেও আনায়াসে আঙ্কেল বলে ডাকে আজকের ২০/২২ বছরের ছেলেমেয়েরা।

আমার আশি বছর বাঁচার কথা। এটা আমার হিসাব নয়, ছোটবেলায় একজন হাত দেখে বলেছিল। সে সময় এটাকে অনন্তকাল মনে হতো। এখনও যে খুব অল্প সময় মনে হয় তা না। আশি বছর বাঁচলে আমি অর্ধেকের বেশি জীবন ইতিমধ্যে পাড়ি দিয়েছি। এইপথ পাড়ি দিতেই প্রচুর ঝামেলা হয়েছে, খুব মসৃণ ছিল এটা বলব না।

ঠিক এর কাছাকাছি আরও একটা পথ পাড়ি দিতে হবে, এটা ভাবলেই কেমন অলস অলস একটা ভাব হয়...একটু ছুটি নিতে ইচ্ছে করে জীবন থেকে। এগুলো সবই মধ্যবয়েসের ভাবনা - খুব কঠিন এই সময়,

জীবনের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা দখল হয়ে যায় এ সময়ে। খালি মনে হয় পালাই-পালাই, স্কুল পালানোর যায় কিন্তু জীবন থেকে পালাবো কেমনে?

আমার যেদিন ত্রিশ বছর বয়েস হয়েছিল, সেদিন ভেবেছিলাম যে একটা মাইলস্টোন পাড়ি দিয়েছি। অথচ শরীরের কোথাও বিশ আর ত্রিশের পার্থক্য ছিল না। বিশ আর ত্রিশ দু'জনেই বেশ চটপটে জোয়ান ছোকরা। সে তুলনায় চল্লিশ অনেক গম্ভীর প্রকৃতির ভদ্রলোক, সকালে হাঁটুর ব্যথা নিয়ে উঠে প্রায়ই তা মনে হয়। চল্লিশের চোখে চশমা, শৈশবের হারানো মাঠের কথা ভাবেন তিনি, ওনার তুলনায় ত্রিশ একদম চটুল যুবক, প্রায় বিশের মতই। তার মনে শৈশব নিয়ে আদ্যিখেতা নেই, আছে যৌবনের বেদনাগুলো। অথচ চল্লিশ ভাবছে - দিন চলে গেলো...

যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আজ এখান থেকে শৈশবের কোলাহলগুলো ঠিক যতদূরে - বার্ধক্যের হাতছানিও ঠিক প্রায় একই দূরত্বে। অবধারিতভাবে আমি উন্মুখ তাকিয়ে রই শৈশবের দিকে, বার্ধ্যকের দিকে নয়। আমি বুড়ো হতে চাই না, পিটারপ্যানের মতো আমার পক্ষে বুড়ো হওয়া আসলেই সম্ভব না, সময় যতই ফন্দি আঁটুক না কেন আমি সেই ক্লাস সিক্সে পড়া বালকই রয়ে যাবো সম্ভবত।

"গলার কাছে পাল তুলেছে

আজগুবি এক স্মৃতির খেয়া

বয়স হওয়ার মানেই বোধহয়

স্মৃতির সঙ্গে আড্ডা দেওয়া

কে বলে হে আড্ডা নাকি

কম বয়সের কথকতা

বয়স হলেই বরং জমে

আড্ডা এবং নিরবতা

নিরবতার অপর পারে

সন্ধ্যে নামার একটু আগে

বয়স হচ্ছে বলেই বোধহয়

হাঁটতে হাঁটতে একলা লাগে

সন্ধ্যে নামার সময় হলে

পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে

মুখ ফিরিয়ে ভাবব আমি

কোন দেশে রাত হচ্ছে ফিকে"

(বয়েস আমার/ কবির সুমন) 

দৌড়

মনুষ্যসমাজের বাইরে আমার একটা বন্ধু ছিল। মার্জার সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তার নাম গর্ডি, তার সাথে আমার খুব সংক্ষিপ্ত বন্ধুত্বের কথা অন্য একটা লেখাতে লিখেছি। সে আমাদের বাসার পেছনে প্রায়ই বসে থাকতো, খেলার ছলে মাঝে মাঝে ইঁদুর মারতো। আমি শুনেছিলাম বিড়ালরা ইঁদুর মেরে প্রিয়জনকে উপহার দেয়। সেই হিসাবে সেই নিহত ইঁদুরগুলো আমার জন্যই কেননা আমার ক্ষীণ ধারণা ছিল গর্ডি আমাকে বন্ধু বলে মনে করে। আমার মেয়েরা গর্ডির অকারণে প্রাণী হত্যা পছন্দ করেনি, তাদের ধারণা ছিল প্রাণীজগত খুব চমৎকার জায়গা, সেখানে সবাই খুব মিলেমিশে বাস করে। গর্ডি এসে একবার রবিবার সকালে আমাদের প্রকৃতির পাঠশালার আসল শিক্ষাটা দিয়ে গেল।

এর পরে অনেক অনেক দিন হয়ে গেছে। গর্ডি নিজেও নিহত হয়েছে তার থেকে বড় প্রাণীর হাতে। আমি আর সামারা বিবিসির ডকুমেন্টারি প্ল্যানেট আর্থ মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। শহর, জঙ্গল, তৃণভূমি, বরফে মোড়া পাহাড়, উষ্ণ মরুভুমি, সমুদ্র - পৃথিবীর যত বৈচিত্র্য আছে সবগুলোতে প্রাণীর জীবন দেখানো হয়েছে এতে। সবগুলো প্রাণীর জীবনের একটা কমন ব্যাপার আছে - তাদের সারাদিন খাবারের পেছনে ছুটতে হয়, নিজের চেয়ে ছোট প্রাণীদের ধরে খেতে হয় অথবা নিজেকে অন্যের খাদ্যে পরিণত করতে হয় অথবা সেটা থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ ছুটতে হয়। জীবন ধারণে ক্লান্তি বা আনন্দ আছে কিনা জানি না - কিন্তু দৌড় আছে। আক্ষরিকভাবেই তারা দৌড়ের উপর থাকে। সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট বা যোগ্যতমের টিকে থাকা বলে যে ব্যাপারটা গর্ডি আমাদের শিখেয়েছিল - এই প্রাণীজগতের আসলে সেটাই প্রথম নিয়ম। স্নেহ, ভালোবাসা এইগুলো সম্ভবত প্রকৃতির গ্র্যান্ড ডিজাইনের সাপ্লিমেন্টারি ব্যাপার স্যাপার।

মানুষের জগতেও সেই একই নিয়ম। আমাদের প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম না করতে হলেও বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করতে হয়। সেই যুদ্ধেরও একই নিয়ম - যোগ্যতমের টিকে থাকা। প্রকৃতি বা সমাজ কোথাও দুর্বলের স্থান নেই। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো তাই আইন করে দুর্বলকে রক্ষা করতে চায়। সেই দুর্বল কখনও অন্য বর্ণের মানুষ, কখনও অন্য ধর্মের মানুষ, কখনও অন্য লিঙ্গের মানুষ, কখনও অন্য মতবাদের মানুষ। যার শক্তি কম সেই আসল সংখ্যালঘু।


আমি বাংলাদেশের খবরাখবর ইদানিং ইচ্ছে করেই কম রাখার চেষ্টা করি। শুধু বাংলাদেশ নয়, খবর জিনিসটা আদতে দুঃসংবাদের সমার্থক একটা ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে। বাংলাদেশ মোটামুটি প্রকৃতির মূল নিয়মে চলে। যার হাতে ১০০ ইউনিট ক্ষমতা আছে সে ৯০ ইউনিট ক্ষমতাধারীর উপর চোটপাট করে, ৯০ ইউনিট চড়াও হয় ৭০ ইউনিটের পরে, ৭০ ইউনিটের ভয়ে ৪০ ইউনিট তটস্থ...যার হর্স পাওয়ার যত কম সে ফুড চেইনের ততই নিচে। প্রকৃতিতে যেমন খুব নির্দিষ্ট নিয়ম আছে কোন প্রাণী কাকে খাবে, কার ভয়ে কে দৌড় দিয়ে পালাবে - তেমন বাংলাদেশেও মোটামুটি সেই রকম নিয়ম বিদ্যমান। সংখ্যালঘুর অধিকার বলে কিছুই নেই, কেননা ক্ষমতার প্যারামিটারে সম্ভবত নব্বুই ভাগ মানুষই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু।

অরিত্রীর আত্মহননের ঘটনার পরে আমি আমার নিজের স্কুল জীবনের কথা ভেবেছি। নিঃসন্দেহে অনেক ভালো শিক্ষকদের আমরা পেয়েছি। কিন্তু সেই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাইকোপ্যাথদের সন্ধানও পেয়েছি। তারা নিজেরাও ফুড চেইনের নিচের তলার মানুষ, জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো স্কুলের বাচ্চাদের উপর এসে ঝাড়তেন। ক্লাস টু-তে থাকতেই আমি শফিক নিজামী নামক বরাহ শাবককে দেখেছি বাচ্চাদের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে পেন্সিল গুজে চাপ দিতে, ক্লাস সিক্সের বাচ্চাকে চাবুক দিয়ে পেটাতো খায়ের মোল্লা। ওহাব স্যার ক্লাস নাইনের ছেলেদের কান ধরে দাঁড়িয়ে রেখে ক্লাস টুয়ের বাচ্চাদের ক্লাসে এনে সেই দৃশ্য দেখাতেন। হালদার স্যার বা বাটু করিম (আনোয়ারুল করিম) স্যার বেত দিয়ে মারতে মারতে প্রায় অজ্ঞান করে দিতেন। গালাগাল তো ফ্রি স্টাইল ছিল। ঢাকা শহরের একদম নামী স্কুলের (সরকারী ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ের) চিত্র এইগুলো। আমরা বন্ধুরা অবশ্য মার নিয়ে ব্যাপক মজা করতাম, সম্ভবত এটাই ছিল আমাদের একমাত্র ডিফেন্স মেকানিজম। বাচ্চারা সম্ভবত এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় সংখ্যালঘু - মার খেয়ে চুপচাপ সহ্য করে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না তাদের। যেকোন প্রাকৃতিক বা মানবিক বিপর্যয়ের সবচেয়ে অসহায় শিকার তাই শিশুরাই।

ল্যাবরেটরি স্কুলে আমার আরেকটা অবসার্ভেশন ছিল - স্যারেরা বুঝেশুনে বেত চালাতেন। অবস্থাপন্ন বা প্রভাবশালী ঘরের ছেলেরা অপেক্ষাকৃত কম মার খেত। সাধারণ ঘরের ছেলেদের কোন বাছবিছার না করেই মারতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে উপরের ক্লাসে মারধোর অপেক্ষাকৃত কম হত। কেননা অর্ধেকের বেশি ছেলে পাশের ঢাকা কলেজে যাবে, স্যারদেরও ওই পথ দিয়ে আসা যাওয়া করতে হবে। এই মার যে কাল সুদে মূলে ফিরবে না - সেই নিশ্চয়তা নেই। আমি মারিয়াকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেছি মেয়েদের স্কুলের অবস্থা কী ছিল। উত্তর যা পেয়েছি সেটা আশাব্যঞ্জক কিছু না। শারিরীক আঘাত না করলেও মানসিক নির্যাতন উঠতে বসতেই চলে। মেয়েরা যেহেতু জন্মগতভাবেই সংখ্যালঘু, সেহেতু ঝিনুক নিরবে সহ পলিসি মেনে তাদের চলতে হয়।

ভিকারুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহনন আমাকে ভীষণ বিষণ্ণ করে দিয়েছে। দুই কন্যার বাবা আমি এই প্রথম নিজেকে একটু বাহাবা দিয়েছি এই ভেবে যে আমার মেয়েদেরকে এই নরকে বাস করতে হচ্ছে না। সরকার দেখলাম ভিকারুন্নেসার কয়েকজন শিক্ষিকাকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু বাকি লক্ষ লক্ষ সাইকো শিক্ষক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে সাইকো পিতামাতা যারা প্রতিদিন বাচ্চাদের শৈশব চুরি (ডাকাতি বলাই ভালো) করে নিচ্ছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের অশ্লীল রাজনৈতিক নেতারা যারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে মোটামুটি ধ্বংস করে দিয়েছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছে ভূমি দস্যুরা যারা এক টুকরো মাঠও ফেলে রাখে নি শিশুদের খেলার জন্য, ঘুরে বেড়াচ্ছে ধর্ষক, ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের ভবিষ্যতের হন্তারকেরা - ক্ষমতার দম্ভে, ফুড চেইনের অনেক অনেক উপরে বসে যারা প্রতিদিন তাড়া করে খেয়ে নিচ্ছে আমাদের তলানিতে ঠেকা অবশিষ্ট সম্ভবনাটুকুকে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বিবিসির প্ল্যানেট আর্থের একটি এপিসোড বাংলাদেশের জন্য করা উচিত। তাড়া খাওয়া প্রাণীর বেঁচে থাকার সংগ্রামের পাশাপাশি তাড়া খাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার গল্পটাও আসা উচিত রূপালি পর্দাতে। রাতের আহারের পরে নরম সোফার উষ্ণতাতে বসে বাকি পৃথিবী দেখতে পারবে। যুদ্ধ নেই, দুর্ভিক্ষ নেই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই - তবুও মানুষ দৌড়ের উপরে, প্যাসিফিক আইল্যান্ডে সাপের তাড়া খাওয়া ইগুয়ানার ছানার মতো।