- ১ -
সামারা তখন একদম ছোট। বয়েস এক বছর হবে খুব বেশি হলে। আনুশা প্রায় তিন বছর। রাতে আমরা সবাই একসাথে শুই। ভূমিতে তোষক পেতে, এতো বড় বিছানা নেই কোথাও। আনুশা আমার এক পাশে, সামারা একটু দূরে ওর মায়ের সাথে। ঘুমানোর আগে আনুশা আমার গা ঘেঁষে এসে বলতো - আব্বু আমি তোমার বুকে শুবো।
এর অর্থ হচ্ছে ওকে বগলদাবা করে আমার শুতে হবে। এতে ডাবল লাভ, আনুশার যেমন ঘুম আসে তেমনি আমিও খুব সহজেই নিদ্রাদেবীর আশীর্বাদ পাই। এমনি একদিন হঠাৎ সামারা বলে উঠল – আব্বু আমি তোমার বুকে শুব। সামারা কথা শুরু করেছে অতি দ্রুতই। এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ছোট ছোট বাক্য বলা শুরু করেছে। তার ভাষা শেখার গুরু তার বোন। সে গুরুমারা বিদ্যায় অভ্যস্ত। সে এটা বলেই তার মা-কে ডিঙ্গিয়ে আমার বগলদাবা হয়ে শুয়ে পড়ে।
সেই থেকে শুরু। অনেকদিন আক্ষরিক অর্থেই আমি দুই মেয়েকে ঘুম পাড়িয়েছি এবং একই সঙ্গে নিজেও ঘুমিয়েছি। আনুশা একদিন বড় হয়ে গেল। সামারা অনেকদিন আমার সাথে লেগে ছিল। কিন্তু সব ভালোকেই এক সময়ে ছেড়ে দিতে হয়। সেও একদিন নিজের ঘর গুছিয়ে বসল। আইকিয়া থেকে পছন্দ করে আসবাব নিয়ে আসলো। আসলো বাহারি বাতি, হাতে উঠে এলো মুঠোফোন, কানে ইয়ার পড নামের এক বিচিত্র জিনিস। শেষ পর্যন্ত সামারাকেও আমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলা, আক্ষরিক এবং অক্ষরহীন – উভয় অর্থেই সামারার দরজা বন্ধ হয়ে গেল আমার জন্য।
আমি সত্যি সত্যি একা হয়ে গেলাম।
- ২ -
বড় হওয়াটা অবশ্যই আনন্দের। বিশেষত সামারার জন্য। সে একরোখা, জেদী মেয়ে। তাকে কিছু করতে বললে - হোয়াই আই হ্যাভ টু ডু ইট? কোথায় যেতে বললে - হোয়াই আই হ্যাভ টু গো? প্রতিটি ব্যাপারেই তার প্রশ্ন, এবং সেই সঙ্গে স্যারকাজামের ধাক্কা।
সকালে ঘুম থেকে নিজে এলার্ম দিয়ে উঠে, রেডি হয়ে নিজেই নাস্তা বানিয়ে খেয়ে নেয়। এরপরে বিড়ালের দেখভাল করে নিজের কাজ শুরু করে। আমাদের কিছুই বলতে হয় না। প্রতিটি ব্যাপারে তার মতামত আছে।
আব্বু ইউ ক্যান নট চেঞ্জ লরেল'স নেইম। ইট উইল হার্ট হার ফিলিং।
বিড়ালটাকে বাড়িতে আনার পরে আমি তার নাম – আইনস্টাইন, নিউটন, ব্রুনো বা স্যাগান – কোন এক মহামানবের নাম দিবো ভেবেছিলাম। কিন্তু সামারার জন্য দেওয়া গেল না।
“শি ডাজ নট নো হার নেইম, লরেল নামটা শেল্টার থেকে দেওয়া, ওরা এ, বি সি ডি - এই সিরিয়ালে নাম দেয়"
"হাউ ডু ইউ নো ইট? ইউ ডোন্ট ওয়ার্ক দেয়ার"
মানুষ ছাড়া আর প্রতিটি প্রাণীর ফিলিং এর ব্যাপারে সামারা খুব সচেতন। খুব সচেতন পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে। একদিন জানা গেলে স্কুলে অংক পরীক্ষাতে মিস বেশি নম্বর দিয়েছিল ভুল করে, সে নম্বর কমিয়ে এনেছে। প্রতিটি ব্যাপারেই তার যুক্তি আছে।
আমি একদিন বললাম – আমার মনে হয় না এই সামারাই সেই সামারা যে আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতো না। আমি অফিসে গেলে আমার জামা পরে বসে থাকতো যে মেয়েটা, সেই মেয়েটা এটা নয়।
সামারা জানালো উল্টোটাও পসিবল, হয়ত আমাকেই কেউ বদলায়ে দিয়েছে।
সেটাও হতে, পারে - জীবনের পরমার্থই হচ্ছে বদলে যাওয়া।
- ৩-
আর একটু পরেই সামারার বয়েস ১৪ হয়ে যাবে। সে আনন্দে আছে, সামনের বছর গাড়ি চালানো শিখবে, সব ঠিক থাকলে পরের ইলেকশনে হয়ত ভোট দিতে পারবে। রাজনৈতিক দর্শনে সামারার অবস্থান অনেকখানি বামদিকে। সেখান থেকে সে আমাকে প্রতিক্রিয়াশীল ডান ভেবে বসে মাঝে মাঝে। আমিও মেনে নিয়েছি জীবনের অবধারিত সত্য। সন্তানের ধনুক থেকে ছুড়ে দেওয়া তীরের মতো - তাদের যাত্রা পশ্চাতে নয়, ওরা আর বুকের মধ্যে শুতে চাবে না। বাসায় ফিরলে আর হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে আসবে না। ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করবে না - হু ডু ইউ লাভ মোস্ট ইন দিজ হোল ওয়াইড ওয়ার্ল্ড? অনন্ত আকাশ যার সামনে, সেকি কখনও পেছনে ফিরে চায়?
শুভ জন্মদিন সামারা। শুভ জন্মদিন। সেই আকাশ স্পর্শ কর।
No comments:
Post a Comment