Wednesday, December 23, 2020

৪৮ নট আউট

লেখাটা হঠাৎই খুঁজে পেলাম। আমার নিজের ভাঙ্গাচোরা একটা ব্যক্তিগত ব্লগ আছে। বহু বছর আগে তৈরি করেছিলাম। জীবনানন্দ দাশের অনুপ্রেরণাতে নাম দিয়েছিলাম ধূসর পাণ্ডুলিপি। নামকরণ সার্থক হয়ে গেছে। সেই পাণ্ডুলিপি এমনই ধূসর আর ধূলিময় হয়ে গেছে যে সেখানে আমার নিজেরই পদচিহ্ন পড়েনি গত কয়েক বছর।

এই লেখাটি আমার চল্লিশ বছরের জন্মদিনে লিখেছিলাম। আমার ব্যক্তিগত ধূসর ব্লগে। ঠিক আট বছর আগে। আট বছর, কুড়ি বছর - এইগুলো কাব্যিক মাইলস্টোন সময়। আট বছরে অনেক কিছু পাল্টেছে, সেই দিন যে ১০ বছরের কিশোর ছিল সে আজকে পূর্ণ যুবক। সময় কি আশ্চর্য বাহন, কী দ্রুতই সে চারিপাশের চেনা চিত্র পাল্টে দিতে পারে। নিচের লেখাটাও সামান্য আঁচড় দিয়ে একটু পাল্টে নতুন মোড়কে চালিয়ে দিচ্ছি।

বার্ধক্যের সাথে আপনার নিজের বয়সের যোগসূত্র আছে কোথাও। সেদিন এক আড্ডায় বলে বসলাম..বাবলু ভাই, উনিতো ইয়াং লোক আমাদের কয়েক বছরের সিনিয়ার, বয়স মাত্র ৪৬। বন্ধুরাও সায় দিল তাতে। আমাদের বয়স যত বাড়ছে, তারুণ্যের সিলিং ততই বেড়ে যাচ্ছে। চল্লিশে এসে এখন মনে হয় ষাট পর্যন্ত মানুষ ছোকরা থেকে যায়। আর ত্রিশ বছর বেচে থাকলে হয়ত নব্বুইকেও যুবক যুবক লাগবে। মনে মনে কেউ নিজেকে বুড়ো ভাবে না বোধহয়।

ক্লাসে টু'তে যখন শুনলাম সাত্তার স্যারের বয়েস ত্রিশ তখন রীতিমত বুড়ো লোক মনে হয়েছিল তাঁকে। এখন নিজের বয়স প্রতি বছর একটু একটু করে বাড়ছে, কমার নাম মাত্র নেই। বিশ বছর আগে যেসব মেয়েদের সাথে টাঙ্কি এবং ইয়ার্কির সম্পর্ক ছিল তারা সবাই বতর্মানে খালাম্মা বলে সম্বোধিত এবং জীবন নিয়ে দারুন ব্যস্ত, অনেকের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানও আছে। আমরাও পুত্র কন্যা নিয়ে ব্যস্ত; আমাদেরকেও আনায়াসে আঙ্কেল বলে ডাকে আজকের ২০/২২ বছরের ছেলেমেয়েরা।

আমার আশি বছর বাঁচার কথা। এটা আমার হিসাব নয়, ছোটবেলায় একজন হাত দেখে বলেছিল। সে সময় এটাকে অনন্তকাল মনে হতো। এখনও যে খুব অল্প সময় মনে হয় তা না। আশি বছর বাঁচলে আমি অর্ধেকের বেশি জীবন ইতিমধ্যে পাড়ি দিয়েছি। এইপথ পাড়ি দিতেই প্রচুর ঝামেলা হয়েছে, খুব মসৃণ ছিল এটা বলব না।

ঠিক এর কাছাকাছি আরও একটা পথ পাড়ি দিতে হবে, এটা ভাবলেই কেমন অলস অলস একটা ভাব হয়...একটু ছুটি নিতে ইচ্ছে করে জীবন থেকে। এগুলো সবই মধ্যবয়েসের ভাবনা - খুব কঠিন এই সময়,

জীবনের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা দখল হয়ে যায় এ সময়ে। খালি মনে হয় পালাই-পালাই, স্কুল পালানোর যায় কিন্তু জীবন থেকে পালাবো কেমনে?

আমার যেদিন ত্রিশ বছর বয়েস হয়েছিল, সেদিন ভেবেছিলাম যে একটা মাইলস্টোন পাড়ি দিয়েছি। অথচ শরীরের কোথাও বিশ আর ত্রিশের পার্থক্য ছিল না। বিশ আর ত্রিশ দু'জনেই বেশ চটপটে জোয়ান ছোকরা। সে তুলনায় চল্লিশ অনেক গম্ভীর প্রকৃতির ভদ্রলোক, সকালে হাঁটুর ব্যথা নিয়ে উঠে প্রায়ই তা মনে হয়। চল্লিশের চোখে চশমা, শৈশবের হারানো মাঠের কথা ভাবেন তিনি, ওনার তুলনায় ত্রিশ একদম চটুল যুবক, প্রায় বিশের মতই। তার মনে শৈশব নিয়ে আদ্যিখেতা নেই, আছে যৌবনের বেদনাগুলো। অথচ চল্লিশ ভাবছে - দিন চলে গেলো...

যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আজ এখান থেকে শৈশবের কোলাহলগুলো ঠিক যতদূরে - বার্ধক্যের হাতছানিও ঠিক প্রায় একই দূরত্বে। অবধারিতভাবে আমি উন্মুখ তাকিয়ে রই শৈশবের দিকে, বার্ধ্যকের দিকে নয়। আমি বুড়ো হতে চাই না, পিটারপ্যানের মতো আমার পক্ষে বুড়ো হওয়া আসলেই সম্ভব না, সময় যতই ফন্দি আঁটুক না কেন আমি সেই ক্লাস সিক্সে পড়া বালকই রয়ে যাবো সম্ভবত।

"গলার কাছে পাল তুলেছে

আজগুবি এক স্মৃতির খেয়া

বয়স হওয়ার মানেই বোধহয়

স্মৃতির সঙ্গে আড্ডা দেওয়া

কে বলে হে আড্ডা নাকি

কম বয়সের কথকতা

বয়স হলেই বরং জমে

আড্ডা এবং নিরবতা

নিরবতার অপর পারে

সন্ধ্যে নামার একটু আগে

বয়স হচ্ছে বলেই বোধহয়

হাঁটতে হাঁটতে একলা লাগে

সন্ধ্যে নামার সময় হলে

পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে

মুখ ফিরিয়ে ভাবব আমি

কোন দেশে রাত হচ্ছে ফিকে"

(বয়েস আমার/ কবির সুমন) 

No comments: