Friday, December 25, 2020

যোগ বিয়োগ

দুই মেয়েকেই আমি অংক করাতাম। অনেকের ধারণা প্রকৌশলীরা অংকে ভালো। ব্যাপারটা পুরো সত্য না। আমি উচ্চতর গণিতের প্রায় পুরোটাই ভুলে গেছি কেননা বুয়েটের অংক পরীক্ষা আসলে মুখস্থ বিদ্যা ছিল। আমার জ্ঞান সুদকষা পর্যন্ত, স্কুলে স্যারেরা ভালো অংক শিখাতেন, ওটা টুকটাক পারি।

যাই হোক বড় মেয়ে নিরীহ গোছের। আমি যা পড়াই সেটা সে মেনে নেয়। সে তখন ক্লাস টু-তে পড়ে। একদিন বিরাট একটা প্রজেক্ট নিয়ে হাজির। লাইফ স্টাইল এনালাইসিস বা এই জাতীয় গালভরা নাম। বিরাট আলোচনা, কিন্তু প্রজেক্টে মূলত দুটি অংশ আছে। একদিকের অংশে প্রচুর প্রশ্ন, কী রকম জীবন চায় সে?
আমরা প্রজেক্ট নিয়ে বসলাম। প্রথমেই বাড়ি - নানান ধরণের বাড়ি আছে। সাদামাটা বাড়িও আছে, পাহাড়ের চূড়ার বাড়িও আছে যেটার জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। আনুশা সেই রকম বাড়িই নিল।
এরপরে আসলো গাড়ি। পাহাড়ের চূড়াতে যে থাকে, তার পক্ষে আমার মতো পুরনো হোন্ডা গাড়ি চালানো শোভা পায় না। আমরা দেখে শুনে একটা ল্যাম্বরগিনি নিলাম।
আনুশার নজর উঁচু, সে বছরে তিনটা ভ্যাকেশন নিবে, একদিন জাপান তো একদিন ব্যক্তিগত ইয়টে চড়ে সমুদ্রে একটু হাওয়া খেয়ে আসবে। খুব মনোযোগের সাথে সে খুব আনন্দ নিয়েই পছন্দের জীবনটা বেছে নিলো।
প্রতিটি চয়েজের সাথেই একটা ডলারের অংক ছিল। জীবনধারা ঠিক করার পরে সেই অংকগুলো যোগ করতে হবে। একটু চেষ্টা টেষ্টা করে আমরা সেগুলো যোগ করলাম। ক্যালকুলেটর জানালো যে যোগে ভুল হয় নি।
এবার অন্যদিকের অংশে নজর দেওয়া হল। সেটা হচ্ছে পেশার অংশ। মানে একেকটা পেশার নাম, সাথে সেই পেশার আয়ের পরিমাণ। এখানে আনুশার বেশি চিন্তা করতে হলো না। আনুশা স্কুলের মাস্টার হতে চায়। স্টক ব্রোকার, বিজনেস এক্সিকিউটিভ, ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, হাইটেকের সিটিও এইগুলো সে খারিজ করে দিলো।
গোল বাঁধলো এইখানেই। আয়ের কলামের সাথে ব্যয়ের কলামের বিস্তর তফাত। স্বপ্নের জীবন আর স্বপ্নের পেশার মধ্যে যোজন যোজন তফাত। স্কুল মাস্টারের আয় দিয়ে সে যে জীবন চাইছে তা অধরাই থেকে যাবে।
জীবনের শুরুতেই ভীষণ দাগা খেয়ে গেল মেয়ে। সে জানালো এই রকম পরিস্থিতিতে সে কি ব্যাংক থেকে টাকা আনতে পারবে কিনা।
আমি আনুশাকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাংক কেন টাকা দিবে তাকে?
আনুশা জানালো ব্যাংক টাকা নিয়ে বসে থাকে মানুষকে সাহায্যের জন্য। যখনই কারো পকেট খালি হয়ে যায় তখনই একটা এটিএম মেশিনে কার্ড ঢুকালে ব্যাংক তাকে টাকা দেয়। আমি মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে এটিএম মেশিন থেকে টাকা তুলি, এরপরে মানিব্যাগটা একটু স্ফিত হয়ে যায়। যেটুকু সে দেখেছে তাতে তার ব্যাংককে মোটামুটি মহামানব মনে হয়েছে।
চূড়ান্ত আঘাত করতে বাধ্য হলাম। ব্যাংকের কাজকর্ম শুনে আনুশা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। আমার টাকাই ব্যাংক আমাকে দেয়, এবং সেই অর্থ উপার্জনের জন্য আমাকে দিনরাত কাজ করতে হয়।
আমি কাজ করছি, উপার্জন করছি, খরচ করছি - এর মধ্যে ব্যাংকের ভূমিকাটা কী? যেই টাকা আমার পকেটে থাকার কথা সেটা কেন ব্যাংক তার উদরে রেখে দিবে?
সব শুনে টুনে আনুশা এক কথায় ব্যাংকিং খাতকে নাকচ করে দিলো।
ইট'স নট ফেয়ার, নট ফেয়ার এট এল। ব্যাংকের উচিত সবাইকে টাকা দেওয়া। আই থিংক দে আর মিন পিপল।
বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ মোটামুটি সত্য। তবে কারো কারো জন্য ব্যাংক বেশ উদার। তারা চাইলেই টাকা পায় বটে। ব্যাংক ডাকাতি হতো বন্দুক নিয়ে, এখন বাংলাদেশে দেখি অনেকের জন্যই আনুশার স্বপ্নের ব্যাংক বসে গেছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে দেখি অনেকেই বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে আসছে ব্যাংক থেকে।
"ডু ইউ হ্যাভ টু ডু দিস ম্যাথ হোয়েন ইউ গ্রো আপ?"
নিদারুণ এক সত্যের মুখোমুখি হয়ে গেলাম আমরা। ক্লাস টু-এর বাচ্চাদের জন্য যে এই প্রজেক্টটা তৈরি করেছেন তাদের ব্যাপারে আমার প্রতিক্রিয়া মিশ্র। এই প্রজেক্টটি আসলে প্রজেক্ট নয়, বরং এটা লাইফ লেসন। আমেরিকাতে বহু বহু মানুষ ক্লাস টু পাশ করলেও এই প্রজেক্টের মূল বক্তব্য তারা ধরতে পারেনি। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের ফাঁদ পেতে রেখেছে। সেই ফাঁদে পা দিলে একবারে ঘরের চাল হারানোর মতো পরিস্থিতি হতে পারে। আমার মনে হয় এই প্রজেক্টটা রিটায়ার করার আগে পর্যন্ত প্রতি বছরই একবার করা উচিত। কিন্তু একই সঙ্গে সাত বছরের মেয়ের আনন্দময় জগতটাকে আয় আর ব্যয় দিয়ে খান খান করে দেওয়ার জন্য সেই পাপিষ্ঠদের ধিক্কার।
মানুষকে এক সময়ে বড় হতে হয়। রূপকথার বাইরে গিয়ে বিশাল পৃথিবীতে ডানা মেলতে হয়। জীবনের একটি অন্যতম অধ্যায় হচ্ছে আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করা। পৃথিবী জুড়ে সবর্ত্রই মানুষ এই অংকে এসে আটকে যাচ্ছে, অনেক সময়ে ইচ্ছেতে, অনেক সময়ে নিরুপায় হয়ে। বড়দের পৃথিবীটা আসলে একটা ফাঁদের মতো, আনন্দ আর সুখের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে প্রলোভনের হাতছানি অথবা অপ্রত্যাশিত অর্থ কষ্ট। যোগ আর বিয়োগ আসলে সবচেয়ে জটিল অংক।
আমি নিজেও পরিপক্ক নই এই খেলাতে। আমিও তাই চাই নি, বড় হতে, এই যোগ বিয়োগের খেলা আমার ভালো লাগে না। এরচেয়ে ফুরিয়র ট্র্যান্সফরমেশন অনেক সহজ, ল্যাপ্লাস ট্র্যান্সফর্মেশনও অত পিলে চমকানো না। কিন্তু বড়দের মূলত যোগ বিয়োগই করতে হয় সারাদিন। ব্যাপারটা দুঃখজনক।
সময়ের চক্রান্তে বড় হয়ে গিয়েছি আমরা, একদম নট ফেয়ার এটা, একদমই নট ফেয়ার!!!

No comments: