Friday, December 25, 2020

ডাউনআন্ডার ৩ঃ বারো শিষ্যের দেশে

নতুন দেশ আবিষ্কারের একটা আনন্দ আছে। কলম্বাসের মতো দেশ দখল আর সম্পদ লুন্ঠনের আনন্দ না। অজানাকে জানার আনন্দ। নিজের পরিসীমা ভেদ করে যাওয়ার আনন্দ, প্রতিদিন যে পথ দিয়ে হেঁটে যেতে হয়, সেটার বাইরেও যে অনেক অনেক বড় একটা পৃথিবী আছে, সেই পৃথিবীর স্বাদ আর গন্ধ নেওয়ার আনন্দ। মুক্তিবেগে সবাই অর্জন করতে পারে না - কিন্তু এরপরেও জানালা দিয়ে বিশ্বসংসার দেখা সম্ভব। আমি নতুন দেশ আবিষ্কারের আনন্দ পেয়েছিলাম শৈশবেই - একদিন তেজগাঁ থেকে রেললাইন ধরে হেঁটে গিয়েছিলাম নাখালপাড়াতে। নাখালপাড়া রেলক্রসিং থেকে পশ্চিম দিকে হেঁটে নতুন একটা ছিমছাম পাড়া দেখেছিলাম। একটা রাস্তার নাম এখনও মনে আছে - ব্যাঙ্কার'স রো। আমার জন্য সেই যাত্রা এক বিস্ময়যাত্রা - বিকেলে বেরিয়ে বিশ্বভ্রমণ শেষে সন্ধ্যের আগেই বাসাতে পৌঁছে গেছি। নতুন একটা দেশ আবিষ্কার করে জমিয়ে রাখতে হয়, সেই বাল্যকাল থেকে আমি জানি। 

ওয়ার্নাম্বুল থেকে আমাদের ঘুরপথে মেলবোর্ন ফেরার কথা। এবার ফিরব সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে। আমি নতুন কোন জায়গাতে গেলেই সেই শৈশবের উত্তেজনাটা বোধ করি। আমরা সকাল সকাল বের হয়েছি। সারাদিন পথে পথে থেমে থেমে মেলবোর্ন পৌঁছাবো বিকেলে বা সন্ধ্যাতে। কোথাও কোন তাড়া নেই। ঘর থেকে বের হয়ে আমরা ছোট এক রাস্তা ধরলাম। চারিদিকে শুনশান নিরবতা, কোথাও সমুদ্রের দেখা নেই। চারিদিকে ছোট ছোট গাছ, ঝোপঝাড়। অস্টিন থেকে একটু বাইরে গেলেই এই দৃশ্য দেখা যায়। আমাদের প্রথম গন্তব্য হচ্ছে টুয়েলভ এপোস্টেইল মেরিন ন্যাশানাল পার্ক।

টুয়েলভ এপোস্টেইল বাইবেল থেকে উঠে আসা নাম। যীশু খৃষ্টের বারোজন প্রধান শিষ্যের নামে এই মেরিন পার্ক। ১৯০০০ হাজার একরের এই পার্কের প্রধান দ্রষ্টব্য হচ্ছে সমুদ্রের ভেতর ফুঁড়ে আসা বারোটি স্তম্ভ। মিনিট তিরিশেক সেই টেক্সাসের মামাতো ভাই টাইপ রাস্তায় চলার পরেই নাটকীয় ভাবে দৃশ্যের পরিবর্তন হল। ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে সমুদ্রের নীল দেখা যেতে লাগলো।

আমারদের ছোট রাস্তাটা হঠাৎ করেই গিয়ে পড়ল সমুদ্রের ধার ঘেঁষে চলা এক রাস্তাতে। ডান দিকে সমুদ্রের গর্জন, কেমন হলদেটে বিস্ময়কর পাথুরে মাটি। দিনটা একদম ঝকঝকে, সমুদ্রের পানিটা গাঢ় নীল। রাস্তার বাম দিকে একটু পর পর ছোট ছোট শহর, প্রচুর গেস্ট হাউজ টাইপের বাড়ি, হোটেল ইত্যাদি। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর টুরিস্ট আসে এইখানে। রাস্তাতে সতর্কবাণীও আছে - অস্ট্রেলিয়াতে রাস্তায় গাড়ি বাম দিকে দিয়ে চলে, সুতরাং খুব খিয়াল কৈরা।অস্ট্রেলিয়ানরা গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে বামপন্থী। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আমারা প্রায়

সারাক্ষণ অস্বস্তি লাগছিল - আমরা উল্টো পথে চলছি কেন? এই সতর্কবাণী আমাদের মতো ডানপন্থী ড্রাইভারদের জন্য।

টুয়েলভ এপোস্টেইল বা বারো শিষ্যের পার্কে আমরা বেশ অনেকক্ষণ ছিলাম। চারিদিকে কেমন সমুদ্রের গর্জন, মানুষের ভিড়, ভেজা বাতাস, আকাশে উড়ছে সিগ্যাল, নীল সমুদ্রে সাদা ফেনা, হলদেটে লাইমস্টোনের পাথর। জীবনানন্দ হাজির হন অবেলাতেই।

"দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি

হে সিন্ধুসারস 

মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি

নাচিতেছ টারান্‌টেলা— রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি

চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায়

ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়।"

(সিন্ধুসারস)।

এখন দুই একটা ব্যাপার বলা দরকার।

আমি গুনে দেখেছি বারো শিষ্যের পার্কে বারোজন শিষ্য নেই। টুয়েলভ এপোস্টেইলের লাইমস্টোনের স্তম্ভ সমুদ্রের আঘাতে আস্তে আস্তে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। বারোশিষ্যের অনেকেই গত হয়েছেন সেই আগ্রাসী সমুদ্রের আক্রমণে। আপাতত ৮ জন অবশিষ্ট আছে। সর্বশেষজন ২০০৫ সালে গত হয়েছেন।

টুরিস্টদের মধ্যে চৈনিক মানুষের সংখ্যা প্রচুর। অনেক নির্দেশনাও চৈনিক ভাষাতে। অস্ট্রেলিয়ার সব শহরেই চৈনিক মানুষদের প্রাচুর্য দেখেছি আমি। চৈনিকরা পৃথিবীর নব্য ধনিক দেশ। তারা যে শুধু দলে দলে বেড়াতে আসে তা-না, মেলবোর্ন সহ অনেক বড় বড় শহরে বাড়ি ঘর, ব্যবসা ইত্যাদি কিনছে তারা।

বাথরুমে হারায়োগ্লিফে বর্ণনা করা আছে কিভাবে সঠিক নিয়ে বাথরুম ব্যবহার করতে হবে। কি ঘটছে এইখানে? দূর ভবিষ্যতের মানুষ হয়ত এইগুলো এনালাইসিস করবে, ঠিক আমরা যেমন গুহাচিত্র দেখে প্রাচীন মানুষের জীবনটা বুঝতে চাই।

হলুদ পাথরের ঝোপের ভেতরে প্রচুর বিষধর সাপ আছে। এই ব্যাপারে বারবার সতর্কবাণী দেওয়া আছে। এখন শীতকাল তাই সেই ভয় নেই। কয়েকমাস পরে আসলে এদের দেখা যাবে। একজন জানালো এইখানে সর্পদর্শন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

বারো শিষ্যের পার্ক থেকে পরের অংশের রাস্তাটা খুবই বৈচিত্রপূর্ণ। পাহাড়ি রাস্তা আছে, আছে মোটামুটি সাইজের একটা অরণ্য, হাহা করা খাদ আর নিচে সমুদ্রের উথাল পাথাল ঢেউ। কোথাও কোথাও রাস্তাটা বাধ্য ছেলের মতো সমুদ্রের একদম কোল ঘেঁষে একেবেঁকে চলে গেছে। রোদ চলে গিয়ে সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল, এরপরে আবার রোদ উঠেছে। দূর সমুদ্রের উপর একটা রংধনু আমাদের ধাওয়া করে চলছে অনেকক্ষণ। এই সমুদ্রের ওই পারেই আন্টার্টিকা মহাদেশ। আমরা হাঁ করে গিলে চলছি প্রকৃতির বৈচিত্র্য, আমাদের স্বাগত জানাতে তার আয়োজনে কোন ত্রুটি নেই।

প্রায় দিন শেষে বিকেলের রোদটা যখন লম্বা হয়ে এসেছে, তখন আমরা থামলাম লর্ন (Lorne) নামের একটা ছোট শহরে। গুগল বলেছে এই শহরের লোক সংখ্যা মাত্র ১১০০। রাস্তার পাশের সমুদ্রের ঠিক একটা পাশের পার্কে আমরা থামলাম। উদ্দেশ্য লেইট লাঞ্চ অথবা অগ্রিম রাতের খাবার - কিছু একটা। নেমেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম - যদি বেঁচে থাকি এই শহরে এসে একবার এক সপ্তাহ থাকবো, প্রতিদিন এসে এই পার্কে বসে থাকবো।

লর্নের কথা বলার একটা কারণ আছে। আমরা ফিশ এন্ড চিপস খেয়েছিলাম একটা দোকান থেকে। দোকানী আমাদের সামনেই একদম তাজা মাছ ভেজে দিলেন। মাছভাজাতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ কোন কম্পিটিশন থাকলে আমি এই লোকটাকে বলতাম সেখানে অংশগ্রহন করতে। এতো ভালো ফিশ এন্ড চিপস আমি কোথাও খাইনি আর। মাছভাজার পাশাপাশি দোকানী আমাদের সাথে সামান্য গল্পও করছিল। আমি টেক্সাস থেকে আসছি শুনে আমাকে জানালো আমি মেক্সিকান বিয়ার পছন্দ করি কিনা। তখন দেখলাম দোকানের ফ্রিজারের থরে থরে রাখা মেক্সিকান করোনা বিয়ার। সে জানালো তার দোকানে এটা নাকি অন্যতম বেস্ট সেলার।

থরে থরে সাজানো করোনা বিয়ারের বোতল দেখে আমি একটু হোমসিক বোধ করি। এই হোম ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে। আমি আছি অস্ট্রেলিয়াতে। বাংলাদেশের পরে আমার সবচেয়ে বেশি নিকটাত্মীয় থাকে অস্ট্রেলিয়াতেই। টেকনিক্যালি চিন্তা করলে আমার হোমসিক হওয়া উচিত না, পরিবারের সবাই কাছেই আছে। এরপরেও মনে হল এক সপ্তাহ আগেও টেক্সাসে ছিলাম, এই শনিবার বিকেলে গরমে ঘামতে ঘামতে পার্কে হাঁটছিলাম।

মাত্র ৫ দিন আগে ছেড়ে আসা অস্টিন শহরের জন্য মন কেমন করে উঠল, ঠিক যেমনটি মাঝে মাঝে করে ২২ বছর আগে ছেড়ে আসা আমার শহরটার জন্য। কোনটা নিজের শহর, কোনটা পরের শহর সেই প্রশ্নের সমাধা হয় নি, সম্ভবত কোনদিনও হবেও না। অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আসার পরে আমি মাঝে মাঝে সামান্য দেখা সেই দেশটাকেও মিস করি। "হোম" ব্যাপারটা আসলেই গোলমেলে...

যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে,

কোনখানে যে মন লুকানো দাও বলে ॥

চপল লীলা ছলনাভরে

বেদনখানি আড়াল করে,

যে বাণী তব হয় নি বলা নাও বলে ॥

No comments: