মনুষ্যসমাজের বাইরে আমার একটা বন্ধু ছিল। মার্জার সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তার নাম গর্ডি, তার সাথে আমার খুব সংক্ষিপ্ত বন্ধুত্বের কথা অন্য একটা লেখাতে লিখেছি। সে আমাদের বাসার পেছনে প্রায়ই বসে থাকতো, খেলার ছলে মাঝে মাঝে ইঁদুর মারতো। আমি শুনেছিলাম বিড়ালরা ইঁদুর মেরে প্রিয়জনকে উপহার দেয়। সেই হিসাবে সেই নিহত ইঁদুরগুলো আমার জন্যই কেননা আমার ক্ষীণ ধারণা ছিল গর্ডি আমাকে বন্ধু বলে মনে করে। আমার মেয়েরা গর্ডির অকারণে প্রাণী হত্যা পছন্দ করেনি, তাদের ধারণা ছিল প্রাণীজগত খুব চমৎকার জায়গা, সেখানে সবাই খুব মিলেমিশে বাস করে। গর্ডি এসে একবার রবিবার সকালে আমাদের প্রকৃতির পাঠশালার আসল শিক্ষাটা দিয়ে গেল।
এর পরে অনেক অনেক দিন হয়ে গেছে। গর্ডি নিজেও নিহত হয়েছে তার থেকে বড় প্রাণীর হাতে। আমি আর সামারা বিবিসির ডকুমেন্টারি প্ল্যানেট আর্থ মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। শহর, জঙ্গল, তৃণভূমি, বরফে মোড়া পাহাড়, উষ্ণ মরুভুমি, সমুদ্র - পৃথিবীর যত বৈচিত্র্য আছে সবগুলোতে প্রাণীর জীবন দেখানো হয়েছে এতে। সবগুলো প্রাণীর জীবনের একটা কমন ব্যাপার আছে - তাদের সারাদিন খাবারের পেছনে ছুটতে হয়, নিজের চেয়ে ছোট প্রাণীদের ধরে খেতে হয় অথবা নিজেকে অন্যের খাদ্যে পরিণত করতে হয় অথবা সেটা থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ ছুটতে হয়। জীবন ধারণে ক্লান্তি বা আনন্দ আছে কিনা জানি না - কিন্তু দৌড় আছে। আক্ষরিকভাবেই তারা দৌড়ের উপর থাকে। সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট বা যোগ্যতমের টিকে থাকা বলে যে ব্যাপারটা গর্ডি আমাদের শিখেয়েছিল - এই প্রাণীজগতের আসলে সেটাই প্রথম নিয়ম। স্নেহ, ভালোবাসা এইগুলো সম্ভবত প্রকৃতির গ্র্যান্ড ডিজাইনের সাপ্লিমেন্টারি ব্যাপার স্যাপার।
মানুষের জগতেও সেই একই নিয়ম। আমাদের প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম না করতে হলেও বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করতে হয়। সেই যুদ্ধেরও একই নিয়ম - যোগ্যতমের টিকে থাকা। প্রকৃতি বা সমাজ কোথাও দুর্বলের স্থান নেই। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো তাই আইন করে দুর্বলকে রক্ষা করতে চায়। সেই দুর্বল কখনও অন্য বর্ণের মানুষ, কখনও অন্য ধর্মের মানুষ, কখনও অন্য লিঙ্গের মানুষ, কখনও অন্য মতবাদের মানুষ। যার শক্তি কম সেই আসল সংখ্যালঘু।
আমি বাংলাদেশের খবরাখবর ইদানিং ইচ্ছে করেই কম রাখার চেষ্টা করি। শুধু বাংলাদেশ নয়, খবর জিনিসটা আদতে দুঃসংবাদের সমার্থক একটা ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে। বাংলাদেশ মোটামুটি প্রকৃতির মূল নিয়মে চলে। যার হাতে ১০০ ইউনিট ক্ষমতা আছে সে ৯০ ইউনিট ক্ষমতাধারীর উপর চোটপাট করে, ৯০ ইউনিট চড়াও হয় ৭০ ইউনিটের পরে, ৭০ ইউনিটের ভয়ে ৪০ ইউনিট তটস্থ...যার হর্স পাওয়ার যত কম সে ফুড চেইনের ততই নিচে। প্রকৃতিতে যেমন খুব নির্দিষ্ট নিয়ম আছে কোন প্রাণী কাকে খাবে, কার ভয়ে কে দৌড় দিয়ে পালাবে - তেমন বাংলাদেশেও মোটামুটি সেই রকম নিয়ম বিদ্যমান। সংখ্যালঘুর অধিকার বলে কিছুই নেই, কেননা ক্ষমতার প্যারামিটারে সম্ভবত নব্বুই ভাগ মানুষই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু।
অরিত্রীর আত্মহননের ঘটনার পরে আমি আমার নিজের স্কুল জীবনের কথা ভেবেছি। নিঃসন্দেহে অনেক ভালো শিক্ষকদের আমরা পেয়েছি। কিন্তু সেই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাইকোপ্যাথদের সন্ধানও পেয়েছি। তারা নিজেরাও ফুড চেইনের নিচের তলার মানুষ, জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো স্কুলের বাচ্চাদের উপর এসে ঝাড়তেন। ক্লাস টু-তে থাকতেই আমি শফিক নিজামী নামক বরাহ শাবককে দেখেছি বাচ্চাদের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে পেন্সিল গুজে চাপ দিতে, ক্লাস সিক্সের বাচ্চাকে চাবুক দিয়ে পেটাতো খায়ের মোল্লা। ওহাব স্যার ক্লাস নাইনের ছেলেদের কান ধরে দাঁড়িয়ে রেখে ক্লাস টুয়ের বাচ্চাদের ক্লাসে এনে সেই দৃশ্য দেখাতেন। হালদার স্যার বা বাটু করিম (আনোয়ারুল করিম) স্যার বেত দিয়ে মারতে মারতে প্রায় অজ্ঞান করে দিতেন। গালাগাল তো ফ্রি স্টাইল ছিল। ঢাকা শহরের একদম নামী স্কুলের (সরকারী ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ের) চিত্র এইগুলো। আমরা বন্ধুরা অবশ্য মার নিয়ে ব্যাপক মজা করতাম, সম্ভবত এটাই ছিল আমাদের একমাত্র ডিফেন্স মেকানিজম। বাচ্চারা সম্ভবত এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় সংখ্যালঘু - মার খেয়ে চুপচাপ সহ্য করে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না তাদের। যেকোন প্রাকৃতিক বা মানবিক বিপর্যয়ের সবচেয়ে অসহায় শিকার তাই শিশুরাই।
ল্যাবরেটরি স্কুলে আমার আরেকটা অবসার্ভেশন ছিল - স্যারেরা বুঝেশুনে বেত চালাতেন। অবস্থাপন্ন বা প্রভাবশালী ঘরের ছেলেরা অপেক্ষাকৃত কম মার খেত। সাধারণ ঘরের ছেলেদের কোন বাছবিছার না করেই মারতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে উপরের ক্লাসে মারধোর অপেক্ষাকৃত কম হত। কেননা অর্ধেকের বেশি ছেলে পাশের ঢাকা কলেজে যাবে, স্যারদেরও ওই পথ দিয়ে আসা যাওয়া করতে হবে। এই মার যে কাল সুদে মূলে ফিরবে না - সেই নিশ্চয়তা নেই। আমি মারিয়াকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেছি মেয়েদের স্কুলের অবস্থা কী ছিল। উত্তর যা পেয়েছি সেটা আশাব্যঞ্জক কিছু না। শারিরীক আঘাত না করলেও মানসিক নির্যাতন উঠতে বসতেই চলে। মেয়েরা যেহেতু জন্মগতভাবেই সংখ্যালঘু, সেহেতু ঝিনুক নিরবে সহ পলিসি মেনে তাদের চলতে হয়।
ভিকারুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহনন আমাকে ভীষণ বিষণ্ণ করে দিয়েছে। দুই কন্যার বাবা আমি এই প্রথম নিজেকে একটু বাহাবা দিয়েছি এই ভেবে যে আমার মেয়েদেরকে এই নরকে বাস করতে হচ্ছে না। সরকার দেখলাম ভিকারুন্নেসার কয়েকজন শিক্ষিকাকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু বাকি লক্ষ লক্ষ সাইকো শিক্ষক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে সাইকো পিতামাতা যারা প্রতিদিন বাচ্চাদের শৈশব চুরি (ডাকাতি বলাই ভালো) করে নিচ্ছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের অশ্লীল রাজনৈতিক নেতারা যারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে মোটামুটি ধ্বংস করে দিয়েছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছে ভূমি দস্যুরা যারা এক টুকরো মাঠও ফেলে রাখে নি শিশুদের খেলার জন্য, ঘুরে বেড়াচ্ছে ধর্ষক, ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের ভবিষ্যতের হন্তারকেরা - ক্ষমতার দম্ভে, ফুড চেইনের অনেক অনেক উপরে বসে যারা প্রতিদিন তাড়া করে খেয়ে নিচ্ছে আমাদের তলানিতে ঠেকা অবশিষ্ট সম্ভবনাটুকুকে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বিবিসির প্ল্যানেট আর্থের একটি এপিসোড বাংলাদেশের জন্য করা উচিত। তাড়া খাওয়া প্রাণীর বেঁচে থাকার সংগ্রামের পাশাপাশি তাড়া খাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার গল্পটাও আসা উচিত রূপালি পর্দাতে। রাতের আহারের পরে নরম সোফার উষ্ণতাতে বসে বাকি পৃথিবী দেখতে পারবে। যুদ্ধ নেই, দুর্ভিক্ষ নেই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই - তবুও মানুষ দৌড়ের উপরে, প্যাসিফিক আইল্যান্ডে সাপের তাড়া খাওয়া ইগুয়ানার ছানার মতো।
No comments:
Post a Comment