রাত তিনটার সময়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল। জেটল্যাগ ব্যাপারটা অদ্ভুত। দূরদেশে গেলে বোঝা যায়। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েও টের পাওয়া গেল। একদিন হয়েছে মেলবোর্নে এসেছি। ঘুম থেকে উঠে শরীরটা একদম ঝরঝরে লাগছে, মানে সকালবেলার মতো। অথচ এখন অস্ট্রেলিয়া বা মার্কিন দেশ কোথাও সকাল বেলা না। সকাল হচ্ছে সম্ভবত প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি কোন জায়গাতে। জেটল্যাগ খতরনাক জিনিস, বিছানা শুয়ে থাকলে ঘুম আসবে না। আমি চা বানিয়ে খেতে খেতে বায়োলজিক্যাল ক্লক নিয়ে চিন্তা করি। আমাদের শরীরের ভেতরের ঘড়িটা জেটপ্লেনে ভ্রমনের জন্য তৈরি হয় নি। সেই কারণেই সে অস্ট্রেলিয়া আর মার্কিন দেশের মধ্যে কোথাও গিয়ে আটকে গেছে। জেটল্যাগ কাটানোর সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে সেটাকে ইগনোর করা। সেটাই করছি, জেটল্যাগ ঠিক করার চেষ্টা না করে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত হওয়াটাই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি। আর সেই পথ তৈরি করা আছে। পরদিনই, মানে শুক্রবার কাজের পরে আমরা দুই দিনের জন্য ঘুরতে বের হচ্ছি। আমাদের গন্তব্য হচ্ছে গ্রেট ওশান রোড। আমার ভায়রা ভাই সোহাগ সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। মধ্যরাতে উঠে আমি গ্রেট ওশান রোড সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ শুরু করলাম। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিন পূর্ব উপকূলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার রাস্তা। নাম শুনেই বোঝা যায় সেই রাস্তা মহাসমুদ্রের পাড় ঘেঁষে। অস্ট্রেলিয়ার পাশে দুটো মহাসমুদ্র, প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগর। ম্যাপ দেখে মনে হল গ্রেট ওশান রোড পুরটাই প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে। একশ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে যুদ্ধফেরত সৈন্যদের দিয়ে এই রাস্তা তৈরি করা হয়। এটা শুধু রাস্তাই নয়, সেই সঙ্গে পৃথিবীর দীর্ঘতম ওয়ার মেমরিয়ালও। শুক্রবার রাতে আমরা মেলবোর্ন থেকে রওনা দিয়ে ওয়ার্নাম্বুল নামের ছোট একটা শহরে থাকবো। মহাসমুদ্রের একদম ধার ঘেঁষে শহরটা। শনিবারে সেইখানেই ঘোরাঘুরি। রবিবার সকালে মেলবোর্নে ফিরব, কিন্তু ঘুরা পথে, গ্রেট ওশান রোড দিয়ে।
আমি গ্রেট ওশান রোডের ছবি দেখতে থাকি। বহুকাল আগে সফটওয়ার ডিজাইন প্যাটার্ন নিয়ে একটু পড়াশুনা করেছিলাম। সফটওয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে লেখা কোডগুলো কতকগুলো প্যাটার্নে ভাগ করে ফেলা যায়। কোড নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাটি করলে ডিজাইন প্যাটার্ন ধরা যায়। সেই আলাপে যাচ্ছি না। তেমনি প্রকৃতিতে ডিজাইনেও কিছু কমন প্যাটার্ন দেখা যায়। সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলোতে মূলত এই জিনিসগুলোর কয়েকটা (বা সবগুলো) বিভিন্ন কম্বিনেশনে থাকে - সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল, নদী, হ্রদ, গিরিখাদ। কিন্তু প্রকৃতির ডিজাইনরা আমাদের অফিসের মোটা মোটা সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের মতো না। একই জিনিস তারা বিভিন্ন জায়গাতে এমনভাবে প্যাকেজ করেন যে ডিজাইন প্যাটার্ন কমন পড়লেও বিস্মিত হতে হবেই। কলোরাডোর পাহাড় আর বান্দরবানের পাহাড় এক জিনিস নয়, দুটোই সুন্দর কিন্তু সেই সৌন্দর্যে ভিন্নতা আছে। অনেকখানি ভিন্নতা তৈরি করে ভূপ্রকৃতি, পশুপাখি আর গাছপালা। কি আছে সেটা জানলেও প্রকৃতির সামনে দাঁড়ালে মুগ্ধ হতেই হয়!!!
নিদির্ষ্ট সময়ে আমরা ওয়ার্নাম্বুলের পথে রওনা দিলাম।যাওয়ার সময়ে সরাসরি চলে যাবো, গ্রেট ওশান রোডে উঠব না। কেননা রাত্রিবেলাতে গাড়ি চালালে স্বর্গ আর নরকের পার্থক্য তেমন বোঝা যায় না। আমরা দুটো পরিবার যাচ্ছি, ৮ জন মানুষ। সোহাগ মানবপাচার করার সাইজের গাড়ি নিয়েছে। সাথে আরও একটি পরিবার যাচ্ছে, দিঠি আর তনয়। আমাদের পেছনে পেছনে ওরা আসবে ওদের গাড়ি চালিয়ে। পথে আমরা ফাস্টফুডের দোকান ম্যাকডোনাল্ডসে থামলাম। দুটো কারণে এই থামার কথা বলা। প্রথমত আমি অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ম্যাকডোনাল্ডসের আধিক্য দেখেছি। এটা এবং কেএফসি ছাড়া অন্য ফাস্টফুডের দোকান তেমন চোখে পড়ে নি। মার্কিন দেশে ম্যাকডোনাল্ডস ছাড়াও প্রচুর ফাস্টফুডের দোকান আছে।সেই সঙ্গে আছে বিস্তর মোটা মানুষ এবং শিশুকিশোর। অস্ট্রেলিয়ানরা ফাস্ট ফুড কম খায় কিনা, এটা গুগল করে পরস্পরবিরোধী তথ্য পেলাম।কিন্তু গুগল জানালো মোটা মানুষ অস্ট্রেলিয়াতেও আছে প্রচুর, প্রায় ৬৪% মানুষ ওভারওয়েট। সেটা থেকে মনে হল ম্যাকডোনাল্ডস একাই তার দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করে যাচ্ছে। যেইখানে পারছে না, সেইখানে কেএফসি দায়িত্ব নিচ্ছে। ম্যাকডোনাল্ডস থেকে বের হয়েই চোখে পড়ল একটা বিলবোর্ড। তাতে লেখা - মেইক অস্ট্রেলিয়া গ্রেট। বিলবোর্ডে আহাম্মক টাইপের একটা লোকের ছবি। দেখে মনে হলো পয়সাওয়ালা লোক, পলিটিক্সে নেমেছে। অল্প একটু গুগল করে সেটাই সত্য মনে হল। পয়সাওয়ালা আর আহাম্মক টাইপের লোক "মেইক সামথিং গ্রেট" টাইপের শ্লোগান নিয়ে আসলেই ইদানিং আমার আতংক লাগে।যেহেতু আমরা ঘরপোড়া গরু, মেইক, গ্রেট আর আহাম্মকদের কম্বিনেশন যে কি ভয়ানক সেটা জানি!!!
আমরা বেশ রাতে ওয়ার্নাম্বুলে পৌঁছালাম। পথে সোহাগের গাড়ি স্পিড ক্যামেরাতে ধরা খেল। অস্ট্রেলিয়ার পথে প্রান্তরে লুকিয়ে আছে শত শত স্পিড ক্যামেরা। সাধারণত ক্যামেরার বসানো অংশের আগে একটা জেনেরিক ওয়ার্নিং দেওয়া থাকে - "সারা দেশে স্পিড ক্যামেরা আছে, বদ্দা আস্তে গাড়ি চালায়েন কইলাম"। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সোহাগ সেই আপ্তবাক্য অগ্রাহ্য করেছিল। স্পিডিং টিকেট বাসাতে পৌঁছে যাবে। যাত্রার শুরুতেই বিপত্তি!!!
যাই হোক এয়ারবিএনবি থেকে নেওয়া বাসাটা চমৎকার। দুই তলা। অনেকগুলো রুম। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে ঘর থেকে দুই কদম বের হলেই সমুদ্র। সামান্য গর্জনও কানে আসছে। আমরা দ্রুত খাবারের ইন্তেজাম করলাম। নানান ধরণের খাবার বানিয়ে আনা হয়েছিল। সেইগুলো গরম করে খাওয়া হল। রাতে আর্জেন্টিনার সাথে ফ্রান্সের খেলা।আমিই একমাত্র ব্রাজিল সমর্থক বাকিরা সবাই মেসিভক্ত আর্জেন্টিনা। এমন এক অবস্থায় মওদুদ আহমেদ স্টাইলে দল পরিবর্তন করে আর্জেন্টিনা সমর্থক গোষ্ঠিতে যোগ দেওয়াই ভালো। হাজার হোক আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল একই মহাদেশের দেশ।
খেলা শুরুর আগে আমরা নানান জিনিস নিয়ে গল্প করলাম। আমরা মানে, সোহাগ, জিনিয়া, দিঠি, তনয়, মারিয়া আর আমি।তনয় আর দিঠিকে আমি জীবনে প্রথমবার দেখছি। জিনিয়ার (মারিয়ার ছোট বোন) সাথে দিঠি স্কুলে পড়ত। কবিতার বাইরে দিঠি শব্দটা আমি কোথাও শুনিনি। নামের মতোই চমৎকার মেয়েটা। গল্প শুরু করার পরে মনেই হল না যে ওদের সাথে আমার এই প্রথম দেখা। প্রবাসে বাংলাদেশিদের সাথে অনেক দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে যেতে পারে, নিজের ভাষায় কথা বলার একটা আনন্দ আছে, নিজের দেশের লোক পেলে সম্ভবত দেশের মাটির গন্ধটাও পাওয়া যায়। আমরা ঢাকার গল্প করলাম, টাইম ডাইলেশন নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা হল, আর্জেন্টিনা অদ্য রজনী ফ্রান্সকে শুইয়ে ফেলবে এই বিষয়ে আমরা সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করলাম। আমি সেই সঙ্গে এটাও জানালাম যে আমি যেই দলকে (বা নির্বাচনের প্রার্থী) সমর্থন করি তারা সাধারণত হেরে যায়।
দুঃখের বিষয় আর্জেন্টিনা ওই রাতেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়ে নিল। কালান্তক জেটল্যাগের ঠেলাতে আমি খেলাটা পুরো দেখতে পারলাম না। পরদিন ভোরের সবার বিমর্ষ মুখ দেখে ভূয়া সাপোর্টার হয়েও আমারও খুব দুঃখ লাগলো আর্জেটিনার জন্য। আমার ধারণা ছিল জার্মানি বিদায় নেওয়ার পরে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার জন্য পথটা সুগম হয়েছে। এমনই এক দুঃসময়ে বারান্দার জানালা খুলে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একশ মিটার দূরেই প্রশান্ত মহাসাগর। একটু আগে বৃষ্টি শেষ হয়েছে। সকালের একটা নরম রোদ উঠব উঠব করছে। আর সমুদ্রের উপরে পুরোটা আকাশ জুড়ে আছে একটা জ্বলজলে রংধনু। এরপরে আর মন খারাপ করে থাকা চলে না।
আমরা ওয়ার্নাম্বুলে ঘুরতে বের হলাম। যেহেতু গ্রেট ওশান রোড দিয়ে ফিরব, সেহেতু ওই পথে গেলাম না।ওয়ার্নাম্বুলের চারিদিকে ভূপ্রকৃতি খুব চমৎকার।একটু পাহাড়ি জায়গা, জঙ্গল আছে, তাতে এমু (Emu) ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনমনে। পাহাড়ি নদীও আছে, ছোট ঝর্নাও আছে। সম্ভবত ফার্মিং হয় প্রচুর। টিভিতে দেখা অস্ট্রলিয়ান গরুর দেখা পাওয়া গেল। গরু থাকলে আইসক্রিম আর চিজের ফ্যাক্টরি থাকে। দূর থেকে সেইগুলোও চোখে পড়ল।
নিচের ছবিগুলো সব ওয়ার্নাম্বুল আর পোর্ট ফেয়ারি এলাকাতে তোলা। অস্ট্রেলিয়ার আকাশ যেমন ঝকঝকে নীল, তেমনি সমুদ্রের পানিও। যে কয়টি বিচে গেছি আমরা, সেগুলো প্রতিটিই খুবই পরিস্কার ছিল। নিচের ছবির সমুদ্রটা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর। আমাদের জানালার বাইরে যে জলরাশি, তার অন্য পাড়ে আছে আন্টার্টিকা মহাদেশে। সম্ভবত বাকি পৃথিবীর আবর্জনা নেই বলেই ওয়ার্নাম্বুলে দেখা সমুদ্রটাকে আমার অসাধারণ পরিস্কার মনে হয়েছে। আর পুরোটা দিনই রোদ আর হালকা বৃষ্টির লুকোচুরিতে কেটেছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল আমাদের সফর উপলক্ষ্যে সারাদিনই মনে হয় প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে একটা রংধনু ফিট করে রাখা আছে। আমাদের রংধনু ভাগ্য খুব ভালো বলতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার যেখানেই গেছি - সেখানেই রংধনু দেখেছি।
প্রকৃতি আমাকে মুগ্ধ করে, মনে হয় বেঁচে থাকা সার্থক। প্রকৃতির ডিজাইন প্যাটার্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ!!!
No comments:
Post a Comment