একবার চুল কাটতে গিয়েছিলাম। সাথে বাচ্চারা ছিল। মাথায় খুব বেশি চুল অবশিষ্ট নেই, কিন্তু যেটুকু আছে সেটার বৃদ্ধির গতি খুব বিরক্তিকর রকম দ্রুত। প্ল্যান করলাম সব চুল কেটে ফেলে দিব। ঝামেলা রাখতে নেই। নাপিতকে সেই প্ল্যান জানানোর পরে সে দ্রুত সাইজ জিরো ক্লিপ দিতে কয়েক মিনিটের মধ্যে কাজ সেরে ফেলল। কিন্তু ঝামেলা শুরু হল এর পরে। আনুশা ডাক ছেড়ে কান্না শুরু করল। সে একদম ছোট বাচ্চা নয়। ক্লাস টু বা থ্রি-তে পড়ে। কান্নার কারণ হচ্ছে আমার চেহারা পাল্টে গেছে। কান্নার মূল বক্তব্য হচ্ছে - আই ওয়ান্ট মাই ওল্ড ড্যাডি ব্যাক। আমার সাথে আমার এক বন্ধু ছিল, সে আর মারিয়া মিলে ঠাণ্ডা করল আনুশাকে। সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে তার “নতুন” বাবা নিয়ে বাসাতে আসলো। আমি আশ্বাস দিলাম যে দেখতে সামান্য অন্যরকম হলেও আমি সেই পুরনো বাবাই। এটা কয়েক বছর আগে ঘটনা। খুব রিসেন্টলি ওজন কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। এই বার সামারা বাঁধা দিচ্ছে, ওজন কমলে আমি দেখতে অন্যরকম হয়ে যাবো। তারও একই দাবী – সে চায় তার বাবা একই রকম থাকুক।
আমার প্রবাস জীবন ২২ বছরের বেশি হয়ে গেছে। প্রতিবার যখন দেশে যাই তখন দেশের যে ছবি দেখি সেগুলোকে চলচ্চিত্র না বলে স্ন্যাপশট বলা উচিত। প্রতিবারই মনে হয় ঢাকা শহর আগেরবারের চেয়ে একটু মলিন, একটু ধূসর হয়ে গেছে। প্রতিবারই মনে হত আব্বা আরেকটু বুড়ো হয়ে গেছেন। আমরা সবাই চাই আমাদের প্রিয় জায়গাগুলো ঠিকঠাক থাকুক একদম আগের মতো। প্রিয় মুখগুলোও থাকুক অমলিন, কালের চিহ্নমুক্ত। ২০১৩ সালে আম্মা মারা যাওয়ার পর দুই বছরে তিন বার দেশে গিয়েছি। প্রতিবার দেখা নতুন স্ন্যাপশটগুলো খুবই কষ্টকর – আব্বা হঠাৎ করে চলৎশক্তি হারিয়ে ফেললেন, আস্তে আস্তে নির্বাক হয়ে গেলেন, তাঁকে অন্য মানুষ খাইয়ে দেয়। কিছুদিন পরে সেটাও সম্ভব হল না, তাঁকে ফিডিং পাইপ দিয়ে খাওয়াতে হয়। তিনি নির্বাক চেয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে একটু হাসি দেন, অনেকদিন পরে অল্প পরিচিত মানুষকে দেখলে যে হাসিটা ঠোঁটের কোনাতে আসে, ঠিক সেই হাসি। আমাকে চিনতে পেরেছেন কিনা সেটা সেই হাসি থেকে বোঝা যায় না। ফিডিং টিউব পাল্টানোর সময় যন্ত্রণাতে ছটফট করতে করতে চিৎকার করেন। পিঠে বেড সোরের ক্ষত। আমি যদি ক্লাস থ্রিতে পড়তাম আনুশার মতো – আমিও চিৎকার করে কাঁদতাম, আই ওয়ান মাই ওল্ড ড্যাডি ব্যাক।
আমার সেই “ওল্ড ড্যাডি” মোটেই এই রকম ভেঙ্গে যাওয়া মানুষ ছিলেন না। ভোর পাঁচটাতে তিনি দিন শুরু করতেন, অফিস করতেন, বাজার করতেন, বাগান করতেন, ব্যাঙ্কে গিয়ে বিল দিতেন, বাসার হাজারটা টুকটাক জিনিস করতেন নিঃশব্দে। বিছানায় নিঃসাড় তাঁকে আমি পড়ে থাকতে দেখিনি। সময় এসে কেড়ে নিয়ে গেছে তাঁকে। আমি আমার বাবার ৪৬ তম জন্মদিনে জন্মগ্রহন করেছিলাম। আমার ছেচল্লিশ বছর হওয়ার ঠিক পাঁচদিন আগে, দুই বছর আগের এই নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ তিনি অন্যভুবনে চলে যান চুপচাপ – তাঁর প্রস্থান ছিল পুরো জীবনের মতোই নিভৃত, নিঃশব্দ।
তাঁর জীবনের শেষের দুই বছরের স্মৃতিগুলো আমি জমিয়ে রাখতে চাই না। জীবন উদযাপন করার জিনিস, কষ্ট মনে রাখার নয়। তাই আমার স্মৃতিকোষে যেই বাবা আছেন তিনি একজন সতেজ, সবুজ মানুষ। সকালে ব্যস্ত হয়ে অফিসে যান, বিকেলে বাগানে গাছের পরিচর্যা। বিশ্বাস করেন "সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং" এর মতো প্রায় ভুলে যাওয়া জীবন দর্শনে। গাছ কেটে ফেললে মনে কষ্ট পান, অকারণে প্রাণী হত্যা করতে নিষেধ করেন।
আশির দশকে তোলা আব্বার কিছু ছবি আমার সংগ্রহে আছে। ছবির এই মানুষটাই আমার বাবা, আমার ছেলেবেলার বাবা, কৈশোরের বাবা, বড়বেলার বাবা। তিনি আমার বৃদ্ধকালের বাবাও হবেন যতদিন না পর্যন্ত স্মৃতিহীনতা এসে হানা না দেয়।
ভালো থাকুন আমাদের সবুজ রঙের বাবা।
No comments:
Post a Comment