Friday, December 25, 2020

ডাউনআন্ডার ১ঃ দূরদেশ

প্রাচীন পৃথিবীতে নাকি সবগুলো মহাদেশ জোড়া লেগে ছিল। ছোটবেলাতে শুনেছিলাম, এটা নিয়ে কোন ঘাঁটাঘাটি করিনি কোনদিন। কেননা পৃথিবীর ম্যাপ দেখে আমার নিজেরও সেই রকম ধারণা হয়েছিল। মহাদেশগুলোর চেহারা কেমন যেন জিগ'স পাজলের মতো - দক্ষিণ আমেরিকা বেশ সুন্দরভাবে আফ্রিকার সাথে জোড়া লেগে যায়। একটু চাপাচাপি করলে অস্ট্রেলিয়ার উপরের অংশ বাংলাদেশের নিচে ফিট করানো যাবে। সেই প্রাচীন মহাদেশে হয়ত ঝালকাঠি থেকে সিএনজি নিয়েই অস্ট্রেলিয়ার ডারউইনে চলে যাওয়া যেত (আমি প্রাচীন মহাদেশগুলোর অবস্থান জানি না - এটা আমার বাল্যকালের ভাবনামাত্র)। মহাদেশগুলো যেমন একজন থেকে আরেকজন দূরে সরে গেছে তেমনি দূরে সরে গেছে মানুষগুলো। মাঝে সমুদ্র যেমন আছে, তেমনি আছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মের দেয়াল। আরও আছে সাদা মানুষ, কালো মানুষ, বাদামী মানুষ - আমাদের এই একমাত্র বাসস্থানকে আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে ভাগ করে ফেলেছি - ভৌগলিক দূরত্বের চেয়ে মানসিক আর আদর্শগত দূরত্ব অনেক বেশি দূরের পথ।

অস্ট্রেলিয়া অনেক দূরের দেশ, বিশেষত আমার বর্তমান বাসভূম থেকে পুরো একদিনের যাত্রাপথ। আমার বড়ভাই সেই মহাদেশে গত ২৩ বছর ধরে থাকেন। মারিয়ার বোনও প্রায় ১২ বছর ধরে সেই মহাদেশবাসী। বাঙালি মধ্যবিত্তকে জীবন আর জীবিকার জন্য আক্ষরিক অর্থেই সাগরপাড়ি দিতে হয়েছে। আমার বাবা জীবিকার জন্য ৫০ মাইল পাড়ি দিয়ে ঢাকা শহরে এসেছিলেন। আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে কয়েক হাজার মাইল। হয়ত একদিন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গ্রহান্তরে পাড়ি দিতে হবে।

অস্ট্রেলিয়াতে যাওয়ার ইচ্ছে অনেকদিনের। অস্ট্রেলিয়া আমার কাছে শুধুই একটা দেশ না। আমাদের পরিবারের একটা অংশ এই দেশেই বড় হচ্ছে। একশ বছর পরে এদের বংশধরেরা কেউ কাউকে চিনবে না। কিন্তু দেখাশোনা না হলে সেই ভবিতব্য ২০ বছর পরেই চলে আসবে। আমার ভাইয়ের সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে। তাদের শৈশবের সময়টাতে আমি ধারেকাছে কোথাও ছিলাম না। কারো শৈশবে অনুপস্থিত থাকলে কি তার বাকিটা জীবনের অংশ হওয়া যায়? কত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় নি।

যাই হোক, জুন মাসের ২৫ তারিখ রাতে সেই প্রতীক্ষিত ক্ষণ চলে এলো। রাত দশ'টায় আমরা কোয়ান্টাস এয়ারলাইন্সের বিমানে চেপে বসলাম। ডালাস থেকে সিডনি - সরাসরি বিমান। বছর দু'য়েক আগে এই ফ্লাইটটা ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম সরাসরি ফ্লাইট। প্রায় ১৭ ঘন্টার পথ। এর আগে ও পিছে ছোট দুটো ফ্লাইটও আছে। সব মিলিয়ে ২৪ ঘন্টার পথ।

কোয়ান্টাসের সার্ভিস চমৎকার। ঝকঝকে নতুন এয়ারবাস ৩৮০ বিমান। খাবারের মান ভালো। ইন ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট মন্দ না। কিন্তু ওয়াইফাই সুবিধা নেই। উঠার পরে লক্ষ্য করলাম বিমানে একজনও মহিলা কেবিন ক্রু নেই। সব পুরুষ মানুষ। এরা কি মদিনা সনদে প্লেন চালায়? খুব অল্প স্যাম্পল সাইজ থেকে বড় ডিসিশনে আসা উচিত না যদিও হরহামেশা আমরা তা-ই করি। এটা বলার মানে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াতে মাত্র একমাস থেকে সেই দেশ সম্বন্ধে কোন ধারণা করা ঠিক না। যদিও আমার লেখাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি সেটা করব, কেননা সেটাই আমজনতার চরিত্র। প্লেনে উঠে ডিনার শেষ করে, ইয়ং শেল্ডনের গোটা চারেক পর্ব দেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। কোন ঝাঁকুনি নেই, আরামদায়ক যাত্রা। প্রায় ৭/৮ ঘন্টা পরে ঘুম ভাঙলো। এইবার দেখলাম এক যাদুমন্ত্রবলে সব কেবিন ক্রু মহিলা। কোয়ান্টাসে নিশ্চয় প্রমীলা রাজ্য চলছে।

আমরা ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সময়ে মেলবোর্ন পৌঁছালাম। টেক্সাসে আমরা গরমে পুড়ছিলাম। ভূগোলের ষড়যন্ত্রে অস্ট্রেলিয়াতে এখন শীতকাল। বাইরে সকালের নরম রোদ। আকাশে মেঘ নেই। সামান্য একটা বাতাস আছে। আকাশ ঝকঝকে নীল। তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। মার্কিন দেশে তাপমাত্রা মাপা হয় ফারেনহাইট স্কেলে। আমি ১৬ কে ৫ দিয়ে ভাগ করলাম, এরপর ৯ দিয়ে গুন করে ৩২ যোগ করলাম। অংকে প্রথম দুইবার ভুল হল, তৃতীয়বার ঠিক ঠাক বের করতে পারলাম। মোটামুটি আরামদায়ক শীত। 

আন্তজার্তিক তারিখ রেখা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অতিক্রম করার কারণে আমার জীবন থেকে ২৬শে জুনটা হারিয়ে গেছে। ২৫ থেকে একদিন ভ্রমণ করে আমি ২৭শে জুনে এসে পড়েছি। আমি ভূগোলের চক্রান্ত নিয়ে ভাবি, সেন্টিগ্রেড আর ফারেনহাইট স্কেল নিয়ে ভাবি, মেলবোর্নের রাস্তা দেখি আর মনে হয় গাড়িগুলো সব রং সাইড দিয়ে চলছে।

আমরা কর্কট ক্রান্তি, বিষুবরেখা, মকর ক্রান্তি আর আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা সব কিছু পাড়ি দিয়েছি। ক্লান্ত লাগা উচিত। কিন্তু লাগছে না। প্রিয়জনের মুখ দেখলে ক্লান্তি লোপ পায়, বাইরে নরম সূর্যের আলো বিরক্তি শুষে নেয়। ঝকঝকে নীল আকাশ দেখলে মনে ভালো লাগা ভিড় করে। আজকে সব কিছু একসাথে আছে। কী চমৎকার একটা দিন!!!

যাক অবশেষে অস্ট্রেলিয়াতে আসা গেল।

No comments: