পাখির ডানার শব্দে সচকিত
সকালবেলার মতো আমার শৈশব
প্রত্যাবর্তনের দিকে ফেরাবে না মুখ
কস্মিনকালেও।
(দশটাকার নোট এবং শৈশব; শামসুর রাহমান)
আমাকে যদি টাইম মেশিন দিত কেউ, তাহলে আমি ঠিক ঠিক চলে যেতাম শৈশবে, যেখানে এখনো একজন আইসক্রিমওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই কপাল কি আমার আছে, যদিও ঘুমে জাগরনে আমার সব ভ্রমণ শৈশবের অভিমুখে। এই সিরিজটা আমার শৈশব নিয়ে। সচলের বলতে গেলে তেমন কারোর সাথেই ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। আমার স্মৃতিকাহিনী পড়ে কার কি লাভ হবে বলতে পারছি না। তবে শৈশব এবং কৈশোরকে ধরতে পারার মাঝে এক ধরনের ব্যক্তিগত সুখ আছে, যতই দূরে যাই ছেলেবেলা থেকে ততই যেন মন ছুঁতে চায় তাকে। স্মৃতিপীড়ায় আনন্দ আছে বেশ, যদি সেই আনন্দের কিছুটাও আপনাদের দিতে পারি তবেই আমি খুশি। তবে আপনাদের বিরক্তি উৎপাদন হলে জানাবেন; থেমে যাব অবশ্যই।
স্বাধীনতার আগে আমার জন্ম। সুতরাং আমার জীবনের প্রথম কিছু অংশ আমি নিশ্চয় পাকিস্তানি (এখন বলি পাক্কু) ছিলাম। একটু বড় হওয়ার পর এটা নিয়ে আমার কিছুটা ক্ষোভ ছিল, আরেকটু পরে জন্মালেইতো আমি বাংলাদেশী হয়ে জন্মাতে পারতাম।
আমার জীবনের প্রথম কয়েক বছর কেটেছে ধানমন্ডির এডুকেশন সেন্টারের (বর্তমানে নায়েম নামে পরিচিত) কলোনীতে। জায়গাটা বিশাল, পেছনে বিডিআর, সামনে গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুল এবং ঢাকা কলেজ। শহরের ঠিক মাঝখানে হলেও জায়গটাতে একটা মফস্বল মফস্বল গন্ধ ছিল। আমরা "সেন্টার" বলতাম জায়গাটাকে। এখনও পুরানো লোকজন মাঝে মাঝে সেন্টার বলে ফেলে, যদিও নাম বদলে গেছে বহু বছর আগে।
১৯৭১ এ জায়গাটা ছিল পাকিস্তান আর্মির সুরক্ষিত এলাকা, অনেকে পালালেও আমাদের সেই উপায় ছিল না তাই অবরুদ্ধ জীবন যাপন চলত আমাদের পরিবারের। যুদ্ধের শেষদিকে শুরু হয় ভারতীয় বাহিনী এয়ার রেইড, অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল বিডিআর যার অবস্থান আমাদের বাসার ঠিক পিছনে। সুতরাং যেকন মুহুর্তে লক্ষ্যভ্রষ্ট বোমার আঘাতের ভয়। আম্মাকে পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম কতখানি ভয়ে ছিলেন তাঁরা, উত্তর ছিল প্রথমে ভয় থাকলে তা পরে কেটে যায়...রাতে মুক্তিবাহিনীর হামলা আর ভারতীয় বোমার আওয়াজ বেশ মধুরই নাকি লাগত।
আমার তিন বছর বয়েসে আমার পরিবার সেন্টার ছেড়ে তেঁজগায়ে আমাদের নিজেদের বাসায় এসে উঠে। এর প্রায় আরো তিন বছর পরে আমি গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে ঢাকা কলেজ, সুতরাং সেন্টার ছেড়ে গেলেও ওই এলাকায় আমার আরো বারো বছর যাতায়াত ছিল। আমার শৈশব এবং কৈশোরের অনেক খানি জুড়েই আছে তেঁজগা আর ঢাকা কলেজ এলাকার স্মৃতি।
স্মৃতির রঙ্গিন কাচের ভেতর দিয়ে তাকালে সবকিছুই মনোরম লাগে -- আমার কথা না, বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন পুরানো পল্টন নিয়ে। সুতরাং শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের ঢাকা যে বর্নিল লাগবে তা আর আশ্চর্য কি। কিন্তু এটাও সত্য যে ঢাকা শহরটা তখনও এরকম অচেনা হয়ে যায় নি। আজকের ঢাকাকে দেখলে মনে হয় শহরটা ধুঁকছে, কিন্তু সত্তর দশক এবং আশির দশকের ঢাকা মনে হয় আসলেই তিলোত্তমা ছিল আজকের এই আধপোড়া শহরটার তুলনায়।
আমার শৈশবের প্রথম স্মৃতি হোল আমার মা...আম্মা যেন কাকে বলছিলেন আমার সম্বন্ধে..."ওর বয়স তো তিন পুরলো"। সময় হিসেব করে দেখলে সালটা হবে ১৯৭৩ এর শেষ দিক। দেশের অবস্থা তখন বেগতিক, দুর্ভিক্ষ শুরু হয় হয়, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার বেশ বিপর্যস্ত। আমার অবশ্য তখন কোন কিছুই বোঝার কথা নয়। কিন্তু গাড়ি থামিয়ে রক্ষীবাহিনীর তল্লাশী, তেঁজগা স্টেশন (আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে) থেকে সারি সারি দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত মানুষের মিছিল...ভাত বড় দুর্লভ তখন...তারা একটু ভাতের ফ্যান পেলেই খুশি...এসব এখনো একটু একটু মনে পড়ে যায়। কার্যকর কোন বিরোধী দল না থাকায় জাসদ তখন ওই ভূমিকায়, মুজিব আমলের শেষদিকে বুয়েটের কোন একজন জুনিয়ার শিক্ষক (নিখিল?) বোমা বানাতে গিয়ে মারা পড়েন এটাও ঝাপসা মনে আছে।
ছাড়া ছাড়া ভাবে চলচ্চিত্রের মত পনেরই অগাস্টের ঘটনা মনে আছে, বাসার সবার হাবভাব থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে সাঙ্ঘাতিক কিছু হয়েছে। আমি স্কুলে ভর্তির কয়েকমাস আগে জিয়াউর রহমান জাসদ সমর্থিত সিপাহী জনতার বিপ্লবে ক্ষমতায় এসেছেন, এবং কয়েদ করেছেন সতত বিপ্লবী কর্ণেল তাহেরকে। এগুলো সবই পড়া ইতিহাস কিন্তু মাঝে মাঝে স্মৃতিতে "Sneak Preview" এর মত কিছু কিছু ছবি দেখি।
তবে এটা বেশ মনে আছে জিয়া আসার পর দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়, আওয়ামি লীগকে মোকাবিলা করতে জিয়া আস্তাকুঁড় থেকে উঠিয়ে প্রতিষ্ঠিত করলেন চিহ্নিত রাজাকারদের। পরবর্তীতে সংবিধানের মুসলমানী করিয়ে যে মৌলবাদের উত্থান হোল, তা থেকে আজো নিস্তার মেলেনি আমাদের। বংগবন্ধু যদি কঠিন হাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেন এবং নিজ দলের লুটেরা চাটুকারদের নিয়ন্ত্রন করতেন তবে বোধহয় অন্যরকম হোত আজকের বাংলাদেশ, হয়ত ভারতের সাথে পাল্লা দিতাম আমরা টেকনোলজিতে। ১৯৭১ এর পর আমরা সামনে হাটিনি বেশি, আমদের হণ্টন বোধহয় বেশি হয়েছে পশ্চাতে।
১৯৭৭ এর অক্টোবরে জাপান এয়ারলাইন্সের একটা বিমান ছিনতাই করে জাপানী রেড আর্মি। বিমানটা পুরান এয়ারপোর্টের পাশে লালদিঘীর মাঠ বলে একটা জায়াগার রাখা ছিল। আমাদের বাসা থেকে হাটা দূরত্বে জায়গাটা, আমরা সদল বদলে গিয়ে দেখে আসলাম দূর থেকে, ফার্মগেটের ব্রীজ থেকেও প্লেনটার লেজ দেখা যেত। আমরা সবাই উত্তেজিত। বিটিভি ছিনতাইয়ের ঘটনা "লাইভ" কভার করছিল, সম্ভবত সেটাই বিটিভির প্রথম লাইভ কভারেজ। স্ক্রিনের কোনায় লেখা "লাইভ", আমাদের ভাড়াটিয়া মতিউর চাচা বোঝালেন "লাইভ" মানে বিমানের সব যাত্রী জীবিত আছেন। জিয়াকে অনেকগুলো ক্যু মোকাবিলা করতে হয়, এই সময়েও একটা ক্যু হয় যার কিছুটা মনে হয় টিভিতে দেখা গেছে। পরে জেনেছি জিয়াউর রহমান নির্দয়ভাবে মানুষ মেরেছেন সেই ঘটনার পরে এবং আরও অনেক অনেক সৈনিক পরবর্তি সময়ে বিভিন্ন ক্যুতে । নিয়তির অনিবার্য পরিণতি বোধহয় তাই লেখা ছিল তার নিজেরও ললাটে। শৈশবের প্রথম স্মৃতির বাংলাদেশকে চিন্তা করে দেখলে বিক্ষুব্ধ ডকুমেন্টারি ফিল্ম মনে হয়।
তবে আমি মোটেও চিন্তিত ছিলাম না উদ্ভট উটে চড়া বসা স্বদেশ নিয়ে। স্কুল কামাই ছিল নিয়মিত। বাবা মা কাজে গেলে আমি ঘুরে বেড়াতাম আপনমনে। আমাদের বাসাটাও মফস্বল শহরের বাসার মত, তেঁজগা পুরো শহর হয়নি তখন। আমাদের বাসায় অনেকগুলো নারিকেল গাছ, আম, লিচু, পেয়ারা, জাম্বুরা, জামরুল (যাকে আব্বা বলতেন মণ্ডাফল), পাশের বাসার কামরাঙ্গা গাছের প্রায় পুরোটাই আমাদের বাসায় পড়েছে যাতে প্রতিদিন টিয়াপাখি আর নানা রঙের প্রজাপতি আসে। আমার দুপুরগুলো কাটত তাদের সাথে। বাসার খুব কাছে বিশাল এক জাম গাছ, যেখানে ভূত না থেকে যায় না। বাসার পাশেই টেকনিকাল কলেজের (পরে নাম হয় বিজ্ঞান কলেজ) পুকুর আর একটু দূরে খ্রীস্টানদের কবরস্থান। সন্ধ্যার পর গা একটু ছমছম করত। আমি গন্তব্যহীন হেটে বেড়াতাম সারাদিন পাড়াময়।
আমি মনে হয় আজও ঘুরে বেড়াচ্ছি গন্তব্যহীন... সফর শেষ করে মন ফিরতে চায় সেই স্বপ্নঘেরা সবুজ শহরে যদিও আজকের ঢাকা থেকে আম, জাম, লিচু, নারিকেল, টিয়া, প্রজাপতি, পুকুর, ভূতপ্রেত সবাই বিতাড়িত হয়েছে, আমিও কি নির্বাসিত না ওদের মতই?