ঝকঝকে একটা দিন, জ্বালা ধরানো নয় বরং বেশ শান্ত ও সুশীল টাইপের রোদ উঠেছে। উত্তাপহীন রৌদ্রকরোজ্জ্বল এই দিনে আকাশটাও বেশ ঘন নীল, খুঁজলে কিছু সাদা মেঘও পাওয়া যাবে। এই রকম দিন আপনি বাস্তবে বেশি না পেলেও স্মৃতির দিনগুলো হরহামেশাই এই ধরনের হয়। আমি মাঝে মাঝে এখনো দেখতে পাই এই রকম একটা দিনে আমাদের বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আমি আর তিথী মুগ্ধ চোখে রেলগাড়ি দেখছি। আর একটু দূরে তাকালেই তেঁজগা শিল্প এলাকার বিষন্ন চিমনীগুলো দেখা যাবে, যেখান থেকে সাদা বা কালো ধোঁয়া বের হয় দিনরাত। আমরা দুজনেই একমত যে এই ধোঁয়াগুলোই আকাশে গিয়ে মেঘ হয়ে যায়, তাই মেঘগুলো সাদা আর কালো।
আমার খুবই পছন্দের বাহন এই রেলগাড়ি। যদি সম্ভব হোত তবে আমার সব চলাফেরা হোত রেলগাড়িতেই। মানুষ খুব বড়লোক হয়ে গেলে প্লেন কিনে শুনেছি, আমার যদি অনেক টাকা হয় কোনদিন তবে আমি কিন্তু প্লেন কিনব না বরং আমার একটা ট্রেন কেনার ইচ্ছা আছে। আমার বাবারও রেলগাড়ি খুব পছন্দের জিনিস ছিল এবং এই একটি কারণেই নিজের বাসা তিনি এমন জায়গায় বানিয়েছেন যেন ঘর থেকে রেলগাড়ি দেখা যায়। এখনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে দূরে রেলগাড়ির শব্দ শুনলে ছেলেবেলার সেই রেলগাড়ির কথা মনে পড়ে...আধোঘুম আধো জাগরণে মনে হয় দূর থেকে নয় মনে হয় অতীত থেকেই আসছে সে শব্দ। ফ্রান্সে মধূসূদনের হোমসিকনেসের ব্যাপারটা আজকাল ভালোই বুঝি।
তিথীকে চিনলেন না তো? ওরা আমাদের বাসায় ভাড়া থাকত। আমাদের বাসাটা তখনও পুরো দোতলা হয়নি, বলা যায় পৌনে দোতলা। আমাদের একতালায় থাকে তিথীরা, আমি আর তিথী প্রায় সমবয়সী। ওদের অনেকগুলো ভাইবোন লিথি, যূথি, সাথী। আমরা কেউ তখন স্কুলে যাই না। তিথীর সাথে আমি খেলি যদিও ওরা দলে ভারি দেখে আমার বেশি পাত্তা মেলে না। হাঁড়ি পাতিল খেলাতে আমি প্রায়ই চাকর-বাকরের ভূমিকা পাই। খুশি মনেই সেই রোল মেনে নেই। যেটা পাওয়া যায় সেটাতেই আমি খুশি, পরবর্তী জীবনে দেখেছি চাওয়া কম থাকলেই জীবনে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে খুশী হওয়া যায়।
যাহোক তিথী আমার জীবনের প্রথম বন্ধু। গার্লফ্রেন্ড দিয়েই জীবন শুরু, কয়জনার থাকে এই ভাগ্য? আমার সাথে অনেক ভাব ছিল তার। সুতরাং ওরা যখন আমাদের বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলল, আমি বেশ মুষড়ে পড়লাম। সত্যি সত্যি একদিন তিথীরা আমাদের বাসা ছেড়ে কাছেই আরেকটা বাসায় চলে যায়। তিথীরা চলে যাওয়ার পর পর আমি কঠিন জ্বরে পড়ি, এখন আমার ধারনা এটা হয় সেপারেশন এংজাইটি থেকে, আমার বয়স তখন পাঁচ টাচ হবে হয়ত। কাছেই থাকত ওরা, আমার বিরহ জ্বরের কথা শুনে সপরিবারে আমাকে দেখতে আসে ওরা, নিমন্ত্রণ দেয় ওদের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার। আমি সুস্থ হওয়ার কয়েকদিন পর ওদের বাসায় বেড়াতে গিয়ে দেখি তিথী নতুন বন্ধু নিয়ে মশগুল, আমাকে পাত্তাও দিল না। বেশ দুঃখ নিয়ে আমি বাসায় ফিরি, আমার রেকর্ড বুকে সেটাই প্রথম মেয়েদের কাছ থেকে পাওয়া বড়সড় আঘাত। সেই শেষ, আর তিথীর সাথে দেখা হয়নি কখনো যদিও ওরা কাছেই থাকত এবং আমার বাবার সাথে ওর বাবার অনেকদিন যোগাযোগ ছিল।
মেয়ের সাথে বন্ধুত্বে কি আঘাত অনিবার্য?
আমার একটা জন্মত্রুটি ছিল যেটা ঠিক করতে আমার জন্মের পর পর দুইটা অপরেশন হয়। ছয় বছর বয়েসে আবার তৃ্তীয় অপরেশন হয়, যেগুলোর ধাক্কায় আমার ছেলেবেলাটা একটু অন্যরকম হয়েছে। আমি একটু রোগাসোগা ছিলাম, হাঁটতেও পারতাম না ঠিকমত। আব্বা আমাকে প্রচুর পায়ের ব্যায়াম করাতেন, আমি বয়সকালে তার সুফল পেয়েছি অনেক। কিন্তু রোগাপটকা এবং কিছুটা প্রতিবন্ধকতার কারনে স্কুলে বা বাসায় শাসন একটু কমই ছিল। আমার মা বাবা দুজনেই চাকরি করতেন, আমি থাকতাম আমার মত। স্কুলে গেলেও কেউ কিছু বলে না, না গেলেও অসুবিধা নেই। স্কুল কামাইয়ের অভ্যাস আমার জীবনেও যায়নি, স্কুলের পর কলেজ, তারপর বুয়েট সবকিছু কামাইয়ের রেকর্ড আছে আমার। মাঝে মাঝে মন চায় অফিস ফেলে পালিয়ে যেতে।
প্রায় একই সময় সাত সমদ্দুর তের নদী পারের দেশ আমেরিকাতে একই সমস্যা নিয়ে আরেকটা মেয়ে জন্ম নেয়। মিয়্যা হ্যাম নামের সেই ছোটখাটো মেয়েটা সেই সমস্যা অতিক্রম করে বিশ্ব জয় করে ফেলেছে ফুটবল খেলে, আর সময় মত বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা আর ব্যায়ামের জোরে তৃতীয় বিশ্বের আমিও সম্পূর্ন একটা স্বাভাবিক জীবন পেয়েছি। ঘটনাক্রমে মিয়্যা হ্যাম আর আমি আজকে একই শহরে থাকি। সেই ছোটবেলায় আরও দুই একজনের কথা শুনেছি যারা ছোট বাচ্চার অপরেশন করতে হবে বলে বাচ্চার চিকিৎসা করাননি, মোটামুটি প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ জীবন উপহার দিলেন সন্তানকে।
আমার হাঁটাচলায় অসুবিধে থাকলেও আমি চঞ্চল ছিলাম। একদিন আমি বাসা থেকে হারিয়ে যাই। খুব বেশি দূরে যাই নি। বাসার দোতলার কাজ তখন চলছে, আমি মিস্ত্রিদের ভারা বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম এক ছুটির দিন সকালে। নামার আর সাহস নেই, সেদিন বোধহয় কাজ বন্ধই ছিল। অনেকক্ষন পরে আমাকে ছাদ থেকে উদ্ধার করা হয় ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায়। আমি কেন চেঁচাইনি সেটা এখনো একটা বিস্ময়।
সামান্য প্রতিবন্ধকতা নিয়েও স্কুলে ভর্তি হলে বেশ সমস্যায় পড়তে হয় বাচ্চাদের। সেই তুলনায় আমার সমস্যা কমই হয়েছে, স্কুলে স্যাররা একটু প্রশ্রয় দিতেন; তুলনা মূলকভাবে অন্য বাচ্চারাও "হার্ড টাইম" দিত না আমার হাঁটাচলার সমস্যা নিয়ে। আমার বাবার অফিসের পিওন রশিদভাই আমাকে স্কুলে আনা নেওয়া করতেন, উনিও নজর রাখতেন আমার দিকে। রশিদভাইয়ের সাথে রিকশা করে স্কুলে যাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় ভ্রমণকাহিনী, তেজঁগা থেকে ল্যাবরেটরি স্কুল অনেকটা পথ, রিকশায় প্রায় ২৫/৩০ মিনিট লাগতো। একেক দিন একেক পথ দিয়ে রিকশা যেত; কোন দিন ফার্মগেট হয়ে গ্রীন রোড দিয়ে অথবা কোন দিন হাতিরপুল হয়ে এলিফেন্ট রোড দিয়ে অথবা কোন কোন দিন বোকা রিকশাওয়ালা শাহবাগ হয়ে ঘুরে যেত। তীরের গতিতে রিকশা ছুটছে আর রশিদভাই আমাকে শক্ত করে হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন...বিস্ময় নিয়ে আমি দেখছি শৈশবের ঢাকা। প্রাণশক্তিতে পূর্ণ মায়াময় এক সুপ্রাচীন যুবক শহর, অনেক বড় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ রাস্তার আইল্যান্ডে, মানুষের কোলাহল চারিদিকে, তার মাঝে মাঝে রিকশার টুং টাং ঘন্টি, ঝলমল করছে চারিদিক... কি ইন্দ্রজালে ঢাকা শহর রয়ে গেল আজো অমলিন আমার স্মৃতিতে, শৈশবের ফেলে আসা শব্দে আর গন্ধে।
সেই থেকে রেলগাড়ির মত রিকশাও আমার দারুন প্রিয় একটা বাহন আমার। ঢাকায় কোনদিন ফেরা হলে আমি একটা প্রাইভেট রিকশা কিনব। হাতিরপুলের রাস্তায় একটা খুব সরু কালভার্ট ছিল, যার তলায় একটা খাল (ড্রেনের বিকল্প বোধহয়), রিকশাওয়ালা রিকশা থেকে নেমে খুব আস্তে আস্তে জায়গা পার করতো...আমি আতঙ্কে কাঠ হয়ে রশিদভাইকে ধরে আছি, এখনো স্পষ্ট মনে আছে। ভয়ে কাতর সেই শৈশবের আমাকে জড়িয়ে রশিদভাই আস্তে আস্তে বলছেন..."ভয়ের কিছু নেই ভাইয়া"...আজ এতোগুলো বছর পর একা একা পথ চলতে মনে হয় এখনো একটা রশিদভাই থাকলে বেশ হোত, ভয় পেলে আমার হাতটা ধরে বলত..."ভয়ের কিছু নেই ভাইয়া"...
অকস্মাৎ দুপুরে চিলের ডাকে আমার শৈশব ফিরে আসে
শ্লেট, চকখড়ি আর বাদামি রঙের
ব্যাগ হাতে। গলিতে আবছা কন্ঠস্বর। আরো কিছু
প্রিয় স্মৃতি আলোড়নকারী শব্দ শোনার আশায়
ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি।
(ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই; শামসুর রাহমান)
No comments:
Post a Comment