আমি দেশ ছাড়ি ১৯৯৬ সালের অগাস্ট মাসে। দিনটাও মনে আছে, অগাস্ট মাসের পাঁচ তারিখ। গুমোট একটা গরম ছিল সেই সকালে। আকাশটাও অনেক মেঘলা ছিল, সেই রঙের সাথে মিল রেখে আমার মনটাও ছিল বেশ ভারি। বর্ষা আমার প্রিয় ঋতু, কিন্তু সেই সকালের প্রবল বর্ষণটা আর দেখা হয়নি, ম্যাকডোনাল্ড ডগলাসের বিমানটা বৃষ্টির আগেই আমাকে একটানে নিয়ে গেছে অনেক দূরে। ছিল দুটো স্যুটকেস, তাতে বোঝাই বঙ্গবাজারের বেঢপ কাপড়-চোপড়, কিছু পড়ার বই, জীবনানন্দ আর শামসুর রাহমানের কবিতা, আমার যা কিছু পার্থিব সম্পত্তি সব এঁটে গেছে সত্তর পাউন্ডের দুটো বাক্সে। স্যুটকেস আঁটেনি শুধু দীর্ঘশ্বাস বরং বুক থেকে সেটা বেরিয়ে এসেছে ক্ষণে ক্ষণে, আমেরিকা নাকি মানুষকে গিলে ফেলে, আবার ফিরতে পারবো তো এই শহরে? কেউ কি অপেক্ষায় থাকবে?
বিমানবন্দরে বন্ধুরা সবাই ছিল, মা আর বাবা ছিলেন। এর আগে একবার কলকাতায় গিয়েছি একা, কিন্তু ওটাকে তো ঠিক বিদেশ বলে মনে হয় না। এবার সত্যি সত্যি বিদেশ যাচ্ছি, একদম গাঁক গাঁক করে ইংরেজি বলা বিদেশ !! বন্ধুরা নানান হালকা রসিকতা করছে... “গিয়া আমার নাম জিগাইস...” “কি হবে জিগাইলে?” “দেখবি কেউ চিনে না...হা হা হা।” “দোস্ত আমগোরে একটু...পত্রিকা...পাঠাইস।” “পাঠামুনে।” “আর শোন মন খারাপ করিস না... পড়াল্যাখা শেষ কইর্যা চইল্যা আইস, তাইলেই খেলা শেষ...যা এইবার খালাম্মার কাছে যা...” সুবোধ বালকের মত আমি মায়ের কাছে যাই। উনিও আশ্বস্ত করেন নানানভাবে। “এইতো অল্প কয়টা দিন মাত্র। খাওয়া-দাওয়া করবে নিয়মিত আর শরীরের যত্ন নিবে।” আব্বার উপদেশও প্রায় কাছাকাছিই। আমি জ্বরের ঘোর লাগা রোগীর মত মাথা নাড়ি। আম্মা আর আব্বা দুজনেই বেশ উৎফুল্ল আমার “উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশগমনে”। একসময় আমারও ডাক পড়ে, আমি ইমিগ্রেশন পেরিয়ে দূর থেকে দেখি আমার স্বজনদের। পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বন্ধুরাও ঢুকছে কেউ কেউ। আম্মা আর আব্বা চোখ মুছছেন নীরবে, এই অশ্রুটা এতক্ষণ যেন আমার ভয়ে কোথাও লুকানো ছিল, আমি সরে যেতেই তারা দখল করেছে মাঠ সদর্পে। আমি হারিয়ে যাই দ্রুতপায়ে...কতোকাল আগে...মনে হয় এইতো সেদিন।
আমার গন্তব্য ছিল পশ্চিম টেক্সাসের ছোট একটা শহর, নাম লাবোক। শহরটা ছিমছাম, বিশ্ববিদ্যালয়টা খুব সুন্দর। লাবোকে গরম যেমনি পড়ে, তেমনি শীতের সময় তুষারপাতও হয়। আমি এসেছি অগাস্ট মাসে, গরমটাই প্রধান। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আশেপাশে ছাড়া টেক্সাসের রাস্তায় কেউই হাঁটাহাঁটি করে না, শুধু হুশহাশ বিশাল দর্শন সব গাড়ি ছুটে যায়। আমাদের বাসাগুলো মনে হয় শহরের সবচেয়ে সস্তা, রীতিমত ভাগ্যহত না হলে এখানে কেউ থাকবে না। ক্লাস শুরু হতে বাকি আছে কিছুটা সময়, আমি দিনের বেলায় কাজ খুঁজছি আর রাতে “সম্পূর্ণ বাংলাদেশে চিত্রায়িত” স্বপ্ন দেখছি । এর মধ্যে একটা স্বপ্ন ছিল এয়ারপোর্ট থেকে স্যুটকেস ফেলে বাসায় চলে এসেছি বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করতে করতে...জেগে উঠে দেখি ছোট এপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে আরো ছোট একটা আকাশ দেখা যাচ্ছে, গাঢ় নীল রঙের সেই ভোরের অচেনা আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই, অথচ ঢাকার আকাশ নিশ্চয়ই এখন নিকষ কালো, রিকশায় করে ফুলার রোডে ঘুরতে দারুণ লাগতো!!! সুমন চট্টোপাধ্যয় ঢাকায় আসছেন প্রথমবারের মত, আমার বন্ধুরা সবাই যাবে দেখতে “তোমাকে চাই”, আর আমি শালা গভীর রাতে আন্ডারগ্র্যাড ছাত্রদের হোমওয়ার্কের খাতার পাঠদ্ধার করছি। আমেরিকানদের হাতের লেখা এতো খারাপ!!!
সামনেই বিয়ে করেছে একবন্ধু। এই নিয়ে নানান প্ল্যান হয় শুনতে পাই। সবাই চাকরি-বাকরি যোগাড় করেছে, আড্ডাগুলোতে জলযোগ হয় প্রচুর। বনানী বাজারের অবৈধ মদ্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে “মাল” কেনা হয় নিয়মিত । এরামের বারে কিংবা কারো বাসায় হঠাৎ বসা মাইফেলের খবর পেলে চিনচিন করে ওঠে বুকের পাঁজর। সবাই কি আমার কথা ভুলেই গেল? সবইতো চলছে নিয়মমাফিক; আব্বা-আম্মাও বেশ আছেন মনে হয়, শুধু বাসাটা নিঃশব্দ হয়ত, আমার ঘরে বন্ধুদের হৈ হুল্লোড় নেই, ঘরদোর মনে হয় অনেক পরিষ্কার থাকে। আমিই শুধু এই পোড়ার দেশে মোটা মোটা সাহেবদের সাথে অনবরত অনুবাদ চালিয়ে যাচ্ছি, এতে কী লাভ এই মহাপৃথিবীর? খিস্তি উগরে দেই সকাল-বিকাল। ফোনের খরচ মিনিটে দুই ডলারের কাছাকাছি, কথাও বলতে পারি না। দেশে একটা ভাঙা মোডেম ছিল, যেটা দিয়ে ই-মেইল চেক করে এক বন্ধু। সেই সব কিছু জানায়। মানুষ পুত্রশোকও ভুলে যায় একদিন আর এটাতো একটা শহর মাত্র!! আমিও আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হতে লাগলাম এই দেশে। স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে পাল্টাতে লাগলো, এগুলো এবার “সম্পূর্ণ বিদেশে চিত্রায়িত”। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার খবর রাখতে লাগলাম, দেখলাম এদের খাবারগুলোও মন্দ নয় তেমন, পানীয়গুলো একদম বৈধ; গুরু-শিষ্য সবাই পান করছেন দেদারসে। সাইনফিল্ডের কমেডিগুলো দারুণ জনপ্রিয়, আমি আঠার মত লেগে থাকি জর্জ কস্টাঞ্জার সাথে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হোমকামিং বা ক্যারল অফ লাইটসের মত অনুষ্ঠানগুলোও মিস দেই না। হলিউডের ছবি আগে থেকেই দেখতাম, এক ডলারে একটু পুরানো ছবি দেখার থিয়েটারে খোঁজ পেলাম একটা, সেখানে হাজিরা দেই নিয়মিত। একটা আধা ভাঙা গাড়ি কিনলাম, সেটা নিয়ে ঘুরে বেড়াই এদিক ওদিক। বন্ধু-বান্ধব জুটে গেল বেশ কিছু, আড্ডাগুলোও মন্দ লাগলো না। দিন কেটে যেতে লাগলো, অনেকদূরে পড়ে থাকা একটা শহরের কথা মনে হয় আমি ভুলেই গেলাম। আমার বয়স বাড়তে লাগলো। নানান ধান্ধায় আমি, কখনও নতুন চাকরির ধান্ধা, কখনও ধান্ধা ভ্যাকেশনে যাবার। সবসময়েই নতুন কোন প্ল্যান। আমার গা থেকে ঢাকা শহরের গন্ধ উবে গেছে মনে হয়। দেশে ফোন করা অনেক সস্তা হয়ে গেছে, কিন্তু দামি হয়ে গেছে আমার সময়। বিয়ে করেছি, সংসারে নতুন অতিথি আসছে, বাড়ির দাম পড়ে গেছে, কেনার মনে হয় এটাই আসল সময়। দুই স্যুটকেস হাতে নিয়ে অচেনা শহরে আসা যুবক কোথায় যেন চলে গেছে। আমার পার্থিব জিনিসগুলোও আর দুই বাক্সে ধরবে না, পুঁজিবাদের মজাটা আমিও জেনে গেছি বোধহয়। পাঁচই অগাস্টের সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে, গিলেই মনে হয় ফেলেছে এই দেশ আমাকে, যদিও আমি টেরই পাইনি কখন গলঃধরন করেছেন আমাকে শ্যাম চাচা!!!
বেশ কয়েকবছর আগে দেখলাম বাংলাদেশের চ্যানেল এনটিভির গ্রাহক হওয়ার বিজ্ঞাপন। এনটিভি ভালো না খারাপ সেটাও জানি না, শুধু এর মালিকের নাম (দুর্নাম?) মাঝে মাঝে পত্রিকাতে দেখি। নিয়ে নিলাম এনটিভি। টিভি দেখার অভ্যাস দেশে থাকতেও বেশি ছিল না। ইনস্টলেশনের দিন দুপুরে বাসায় লাঞ্চ করতে আসলাম। দেখলাম বিটিভির খবর হচ্ছে। এতবছর পরেও খবরের কোন উন্নতি নেই, প্রতিবেলাই কি দেখতে হবে এই জিনিস? নাহ...দেখলাম নানান উপাদেয় জিনিস দেখা যায়। কখনও ঢাকায় জলাবদ্ধতা, কখনও গরম, কখনও ঠান্ডা, কখনও রাস্তা আটকে মিছিল, কখনও পহেলা বৈশাখের মেলার সংবাদ। সকালে অন্যরা ওঠার আগেই আমি দেখি সংবাদগুলো। অনেক উন্নত হয়েছে সংবাদসহ অনেক অনুষ্ঠানের মান। ঢাকার রাস্তাগুলো দেখলেই অনেক স্মৃতি ভেসে উঠে, হারিয়ে যাওয়া সেই যুবক মনে হয় ফিরে আসে ক্ষণিকের জন্যে হলেও। পলাশি, সাইন্স ল্যাব, ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, মহম্মদপুর, শ্যামলী, ইন্দিরা রোড, শুক্রাবাদ, কলাবাগান, এলিফেন্ট রোড, ফার্মগেট, মিরপুর, মগবাজার, গ্রীন রোড, নিউমার্কেট, রাজারবাগ, বনানী, গুলশান, উত্তরা, মালিবাগ, শাহবাগ, টিএসসি, বিজয়নগর তোমাদের কথা মনে পড়ে যায় ঠিকঠাক, গত জন্মের স্মৃতির মত।
বিমানবন্দরে বন্ধুরা সবাই ছিল, মা আর বাবা ছিলেন। এর আগে একবার কলকাতায় গিয়েছি একা, কিন্তু ওটাকে তো ঠিক বিদেশ বলে মনে হয় না। এবার সত্যি সত্যি বিদেশ যাচ্ছি, একদম গাঁক গাঁক করে ইংরেজি বলা বিদেশ !! বন্ধুরা নানান হালকা রসিকতা করছে... “গিয়া আমার নাম জিগাইস...” “কি হবে জিগাইলে?” “দেখবি কেউ চিনে না...হা হা হা।” “দোস্ত আমগোরে একটু...পত্রিকা...পাঠাইস।” “পাঠামুনে।” “আর শোন মন খারাপ করিস না... পড়াল্যাখা শেষ কইর্যা চইল্যা আইস, তাইলেই খেলা শেষ...যা এইবার খালাম্মার কাছে যা...” সুবোধ বালকের মত আমি মায়ের কাছে যাই। উনিও আশ্বস্ত করেন নানানভাবে। “এইতো অল্প কয়টা দিন মাত্র। খাওয়া-দাওয়া করবে নিয়মিত আর শরীরের যত্ন নিবে।” আব্বার উপদেশও প্রায় কাছাকাছিই। আমি জ্বরের ঘোর লাগা রোগীর মত মাথা নাড়ি। আম্মা আর আব্বা দুজনেই বেশ উৎফুল্ল আমার “উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশগমনে”। একসময় আমারও ডাক পড়ে, আমি ইমিগ্রেশন পেরিয়ে দূর থেকে দেখি আমার স্বজনদের। পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বন্ধুরাও ঢুকছে কেউ কেউ। আম্মা আর আব্বা চোখ মুছছেন নীরবে, এই অশ্রুটা এতক্ষণ যেন আমার ভয়ে কোথাও লুকানো ছিল, আমি সরে যেতেই তারা দখল করেছে মাঠ সদর্পে। আমি হারিয়ে যাই দ্রুতপায়ে...কতোকাল আগে...মনে হয় এইতো সেদিন।
আমার গন্তব্য ছিল পশ্চিম টেক্সাসের ছোট একটা শহর, নাম লাবোক। শহরটা ছিমছাম, বিশ্ববিদ্যালয়টা খুব সুন্দর। লাবোকে গরম যেমনি পড়ে, তেমনি শীতের সময় তুষারপাতও হয়। আমি এসেছি অগাস্ট মাসে, গরমটাই প্রধান। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আশেপাশে ছাড়া টেক্সাসের রাস্তায় কেউই হাঁটাহাঁটি করে না, শুধু হুশহাশ বিশাল দর্শন সব গাড়ি ছুটে যায়। আমাদের বাসাগুলো মনে হয় শহরের সবচেয়ে সস্তা, রীতিমত ভাগ্যহত না হলে এখানে কেউ থাকবে না। ক্লাস শুরু হতে বাকি আছে কিছুটা সময়, আমি দিনের বেলায় কাজ খুঁজছি আর রাতে “সম্পূর্ণ বাংলাদেশে চিত্রায়িত” স্বপ্ন দেখছি । এর মধ্যে একটা স্বপ্ন ছিল এয়ারপোর্ট থেকে স্যুটকেস ফেলে বাসায় চলে এসেছি বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করতে করতে...জেগে উঠে দেখি ছোট এপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে আরো ছোট একটা আকাশ দেখা যাচ্ছে, গাঢ় নীল রঙের সেই ভোরের অচেনা আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই, অথচ ঢাকার আকাশ নিশ্চয়ই এখন নিকষ কালো, রিকশায় করে ফুলার রোডে ঘুরতে দারুণ লাগতো!!! সুমন চট্টোপাধ্যয় ঢাকায় আসছেন প্রথমবারের মত, আমার বন্ধুরা সবাই যাবে দেখতে “তোমাকে চাই”, আর আমি শালা গভীর রাতে আন্ডারগ্র্যাড ছাত্রদের হোমওয়ার্কের খাতার পাঠদ্ধার করছি। আমেরিকানদের হাতের লেখা এতো খারাপ!!!
সামনেই বিয়ে করেছে একবন্ধু। এই নিয়ে নানান প্ল্যান হয় শুনতে পাই। সবাই চাকরি-বাকরি যোগাড় করেছে, আড্ডাগুলোতে জলযোগ হয় প্রচুর। বনানী বাজারের অবৈধ মদ্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে “মাল” কেনা হয় নিয়মিত । এরামের বারে কিংবা কারো বাসায় হঠাৎ বসা মাইফেলের খবর পেলে চিনচিন করে ওঠে বুকের পাঁজর। সবাই কি আমার কথা ভুলেই গেল? সবইতো চলছে নিয়মমাফিক; আব্বা-আম্মাও বেশ আছেন মনে হয়, শুধু বাসাটা নিঃশব্দ হয়ত, আমার ঘরে বন্ধুদের হৈ হুল্লোড় নেই, ঘরদোর মনে হয় অনেক পরিষ্কার থাকে। আমিই শুধু এই পোড়ার দেশে মোটা মোটা সাহেবদের সাথে অনবরত অনুবাদ চালিয়ে যাচ্ছি, এতে কী লাভ এই মহাপৃথিবীর? খিস্তি উগরে দেই সকাল-বিকাল। ফোনের খরচ মিনিটে দুই ডলারের কাছাকাছি, কথাও বলতে পারি না। দেশে একটা ভাঙা মোডেম ছিল, যেটা দিয়ে ই-মেইল চেক করে এক বন্ধু। সেই সব কিছু জানায়। মানুষ পুত্রশোকও ভুলে যায় একদিন আর এটাতো একটা শহর মাত্র!! আমিও আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হতে লাগলাম এই দেশে। স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে পাল্টাতে লাগলো, এগুলো এবার “সম্পূর্ণ বিদেশে চিত্রায়িত”। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার খবর রাখতে লাগলাম, দেখলাম এদের খাবারগুলোও মন্দ নয় তেমন, পানীয়গুলো একদম বৈধ; গুরু-শিষ্য সবাই পান করছেন দেদারসে। সাইনফিল্ডের কমেডিগুলো দারুণ জনপ্রিয়, আমি আঠার মত লেগে থাকি জর্জ কস্টাঞ্জার সাথে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হোমকামিং বা ক্যারল অফ লাইটসের মত অনুষ্ঠানগুলোও মিস দেই না। হলিউডের ছবি আগে থেকেই দেখতাম, এক ডলারে একটু পুরানো ছবি দেখার থিয়েটারে খোঁজ পেলাম একটা, সেখানে হাজিরা দেই নিয়মিত। একটা আধা ভাঙা গাড়ি কিনলাম, সেটা নিয়ে ঘুরে বেড়াই এদিক ওদিক। বন্ধু-বান্ধব জুটে গেল বেশ কিছু, আড্ডাগুলোও মন্দ লাগলো না। দিন কেটে যেতে লাগলো, অনেকদূরে পড়ে থাকা একটা শহরের কথা মনে হয় আমি ভুলেই গেলাম। আমার বয়স বাড়তে লাগলো। নানান ধান্ধায় আমি, কখনও নতুন চাকরির ধান্ধা, কখনও ধান্ধা ভ্যাকেশনে যাবার। সবসময়েই নতুন কোন প্ল্যান। আমার গা থেকে ঢাকা শহরের গন্ধ উবে গেছে মনে হয়। দেশে ফোন করা অনেক সস্তা হয়ে গেছে, কিন্তু দামি হয়ে গেছে আমার সময়। বিয়ে করেছি, সংসারে নতুন অতিথি আসছে, বাড়ির দাম পড়ে গেছে, কেনার মনে হয় এটাই আসল সময়। দুই স্যুটকেস হাতে নিয়ে অচেনা শহরে আসা যুবক কোথায় যেন চলে গেছে। আমার পার্থিব জিনিসগুলোও আর দুই বাক্সে ধরবে না, পুঁজিবাদের মজাটা আমিও জেনে গেছি বোধহয়। পাঁচই অগাস্টের সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে, গিলেই মনে হয় ফেলেছে এই দেশ আমাকে, যদিও আমি টেরই পাইনি কখন গলঃধরন করেছেন আমাকে শ্যাম চাচা!!!
বেশ কয়েকবছর আগে দেখলাম বাংলাদেশের চ্যানেল এনটিভির গ্রাহক হওয়ার বিজ্ঞাপন। এনটিভি ভালো না খারাপ সেটাও জানি না, শুধু এর মালিকের নাম (দুর্নাম?) মাঝে মাঝে পত্রিকাতে দেখি। নিয়ে নিলাম এনটিভি। টিভি দেখার অভ্যাস দেশে থাকতেও বেশি ছিল না। ইনস্টলেশনের দিন দুপুরে বাসায় লাঞ্চ করতে আসলাম। দেখলাম বিটিভির খবর হচ্ছে। এতবছর পরেও খবরের কোন উন্নতি নেই, প্রতিবেলাই কি দেখতে হবে এই জিনিস? নাহ...দেখলাম নানান উপাদেয় জিনিস দেখা যায়। কখনও ঢাকায় জলাবদ্ধতা, কখনও গরম, কখনও ঠান্ডা, কখনও রাস্তা আটকে মিছিল, কখনও পহেলা বৈশাখের মেলার সংবাদ। সকালে অন্যরা ওঠার আগেই আমি দেখি সংবাদগুলো। অনেক উন্নত হয়েছে সংবাদসহ অনেক অনুষ্ঠানের মান। ঢাকার রাস্তাগুলো দেখলেই অনেক স্মৃতি ভেসে উঠে, হারিয়ে যাওয়া সেই যুবক মনে হয় ফিরে আসে ক্ষণিকের জন্যে হলেও। পলাশি, সাইন্স ল্যাব, ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, মহম্মদপুর, শ্যামলী, ইন্দিরা রোড, শুক্রাবাদ, কলাবাগান, এলিফেন্ট রোড, ফার্মগেট, মিরপুর, মগবাজার, গ্রীন রোড, নিউমার্কেট, রাজারবাগ, বনানী, গুলশান, উত্তরা, মালিবাগ, শাহবাগ, টিএসসি, বিজয়নগর তোমাদের কথা মনে পড়ে যায় ঠিকঠাক, গত জন্মের স্মৃতির মত।
No comments:
Post a Comment