সব মানুষেরই মনে হয় একটা পরিসীমা থাকে। আমাদের সকল দৈনন্দিন আর পার্থিব জগতের দূরত্বগুলো মাপার জন্য আছে নানান পরিমাপ, আছে নানান দ্রুতগামী আর শ্লথ সব বাহন। জাগতিক সবই কিছুই আমরা করি এক পরিসীমার ভেতরে থেকে। শুধু স্মৃতির শহরেই এসব কিছুর বালাই নেই, সেখানে স্থান-কাল-পাত্র সবকিছুই অর্থহীন, পার্থিব সবই মূল্যহীন। একটা মিমি চকোলেটের জন্য আক্ষেপও শেয়ার মার্কেটে কোটি টাকার হারানোর বেদনার চেয়ে বেশি হতে পারে। আমরা যতই বড় হতে থাকি বাস্তব জগতটা ততই হানা দিতে থাকে আর তার থাবায় দূরে সরে যেতে থাকে এক স্মৃতিময় শহর। কিন্তু তাও স্থানে-অস্থানে নাছোড়বান্দা শৈশব হানা দেয় আর ফিরে ফিরে আসে সেই শহর। চলুন আজ ঘুরে দেখি আমার সেই নগরী, একটা সিটি ট্যুর নিলে আজ মন্দ হয় না, স্মৃতির শহরে কখনোই যানজট হয় না, আজ দিনটাও মন্দ নয়, এই মেঘ এই বৃষ্টি, এই রোদ, এই গরম, এই ঠান্ডা, এই শহরের মানুষজন আছে ভালোই।
আমাদের তেজগাঁকে প্রায় গ্রামই বলা চলে। স্টেশন রোডে বাড়ি মাত্র পাঁচটা। মানুষ মতিঝিলে গেলে বলে টাউনে যাচ্ছি। আর বলবে নাই বা কেন? এটা পুরোদস্তুর একটা স্টেশন, সাদা সিমেন্টের দেওয়ালের জ্বলজ্বলে কালো অক্ষরে লেখা আছে স্টেশনের নাম। টিটিকে ম্যানেজ করে অনেক দুষ্ট লোকই বিনা টিকেটে টুক করে নেমে যায়, পরের স্টেশন হচ্ছেই কমলাপুর, ওটাই ঢাকার আসল স্টেশন, ওখানে ফাঁকি মারা একটু কঠিনই মনে হয়। একটা বইয়ের দোকান আছে, সেখানে পাওয়া যায় প্রগতির বই আর রাশান ম্যাগাজিন স্পুটনিক। আরও আছে একটা চায়ের দোকান তাতে টিমটিমে একটা বাতি জ্বলে দিনরাত, পিঁপড়ে মাখা শুকনো কিছু বাটারবন আর সস্তা বিস্কুট এইটুকুই সম্বল। এছাড়াও ভিখিরি, ভাসমান পতিতা, নেশারু, দালাল, তাসের আড্ডা, খোলা নর্দমা, বিশ্বসেরা আরামবাগ রেস্তোঁরা...সব মিলিয়ে জায়গাটা কিন্তু মন্দ নয় একদম, এত কিছু একসাথে আর পাবেন কোথায়?
স্টেশনের হালই বলে দেয় যে এখানে মালদার লোকেরা পদধূলি দেন না, যদিও বেলা-অবেলায় তেজগাঁয় ভীড় লেগেই থাকে। আমাদের তাও গর্বের শেষ নেই, বড় পুরানো এই উপশহর, আমরা কয়দিন আগেই রানী জপমালা গির্জার ৩০০ বছর পূর্তি নিয়ে সপ্তাহব্যাপি উৎসব করেছি। প্রখ্যাত অধ্যাপক মুনতাসির মামুন তাঁর “স্মৃতি-বিস্মৃতির শহর” বইতে তেজগাঁ নিয়ে বলেছেন...
১৭৮৯ সালের কোম্পানীর এক নথিতে জানা যায়, তেজগাঁয় ইংরেজ কুঠি কাপড় ধোয়ার (মসলিন) জন্য বড় একটি পুকুর খনন করেছিলো। মিশনারী রেভারেন্ড রবিনসন ১৮৩৯ সালে লিখেছিলেন , ঢাকা হতে ছ'মাইল দূরে তেজগাঁ একটি গ্রাম। ঢাকা থেকে তেজগাঁ যেতে হলে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পেরুতে হয়...সেই জঙ্গল পেরুবার সময় সতর্ক থাক বাঞ্ছনীয় কারণ বাঘের উৎপাত আছে। তেজগাঁর গীর্জা 'জপমালা রাণীর গীর্জা', হিসাবেও পরিচিত। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পর্তুগীজরা। তাঁরাই ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রথম যাঁরা প্রচার করেছিলেন খ্রিষ্টান ধর্ম। মোহাম্মদ শামসুল হক বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা ও স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে এর প্রতিষ্ঠা সময় নির্ণয় করেছেন যা যুক্তিযুক্ত। তিনি এর প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ করেছেন ১৬৭৭ সাল বলে, যখন শায়েস্তা খান ও পর্তুগীজদের মধ্যে যুদ্ধ ও শান্তিচুক্তি হয়েছিলো।
একটা রিকশা ধরে শহরে ঘুরবেন নাকি একটু? দাঁড়ান রশীদ ভাইকে বলি। উনি এখন স্থায়ীভাবে স্মৃতির শহরেই থাকেন, আমাকে যাঁরা ভালোবাসতেন তাঁদের মধ্যে উনি একদম সামনের দিকে সারিতেই আছেন। কাজ করেন আমার আব্বার অফিসে...রোগা, গালভাঙ্গা, পরণে একটা সাদা শার্ট আর লুঙ্গি । আমি সাত বছরের বালক, সাথে রশীদ ভাই থাকলে ভালোই হবে।
রিকশা স্টেশনটা ছাড়িয়ে ফার্মগেটে যাওয়ার পথে পাবেন আমাদের ডাক্তার সাহেবের দেখা, ডঃ অমরচাঁদ রায়, এমবিবিএস, এফসিপিএস (অধ্যয়নরত)। এই পঞ্চাশ বছর বয়েসেও উনি এফসিপিএস অধ্যয়ন করেই চলছেন, পাশ করা আর হয়ে উঠেনি কস্মিনকালেও। তাতে কী? ওনার এন্টিবায়োটিক খেলেতো রোগ সারে তাই না? তাছাড়া এমবিবিএস থাকলেই ডাক্তার, আর বাকিগুলো সব ফাউ ডিগ্রি।
রিকশা ফার্মগেট পার হয়ে বন্দুকের গুলিতে ছুটে চলেছে এয়ারপোর্ট রোড ধরে। ফার্মগেটে আর থামলাম না। আপনাদের তো নিয়ে গিয়েছি ফার্মগেটে, মনে আছে? এখন রশীদভাইয়ের হাত ধরে বসে থাকাই শ্রেয়। আপনি যদি সেদিনের ছোকরা হন, তাহলে একটু অবাকই হবেন। এটা ভিআইপি রোড, রিকশা এখন আর চলে না। কিন্তু স্মৃতির শহরে মনে হয়ে ভিআইপিরাও রিকশা চড়তেন তাই ওখানে রিকশা চলতে কোন বাধা নেই।
রাস্তার মাঝখানের আইল্যান্ডে কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি দেখে অবাক হচ্ছেন? চুপিচুপি একটু ভবিষ্যতবানী করি...এই শহরে এক নতুন শাসক এসেছেন, উনি আর কিছুদিন পরেই এই গাছগুলোকে মৃত্যুদন্ড দিবেন। তবে জীবননাশের আশঙ্কায় ওরা ভীত নয়, নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে আর কিছু বড় সম্পদ নেই, সেটা সেই বিপ্লবীর মত এই গাছগুলো মনে হয় জানে।
একটু সামনে গেলেই দেখবেন জলাভূমি, দুধারেই। এগুলো মনে হয় ঢাকার বর্জ্য পানি বের করে দেয়, একটু দূরে বেগুনবাড়ি খাল, সেটা আরও বড় জলাধার। আমার ভবিষ্যতবানী হলো, এখানে জলাভূমি ভরাট করে আমরা হোটেল, শপিং মল, অফিস আর রেস্তোঁরা বানাবো নিকট ভবিষ্যতেই, আমরা যে আত্মঘাতী বাঙালি, আমাদের ভবিষ্যত দেখতে বেশি দূরদৃষ্টি লাগে না। যদি সম্ভব হতো আমরা মহাশূন্যও মাটি দিয়ে ভরাট করে “বসুন্ধরা-২” বানাতাম।
কাবাব আর পরোটার গন্ধ নাকে আসছে না? ওটা আসছে দারুল কাবাব থেকে। বাংলা মোটর আর কয়েক কদম দূরে, এই জায়গা কাবাবের সুরে আর ছন্দে ভরে থাকে দিনরাত। ওদের চিকেন টিক্কা আর পরোটা খেলে পরজন্মেও মনে থাকবে এর কথা। “রায়তা” নামে যে এক বস্তু আছে সেটাতো ওদের কাছ থেকেই আমার শেখা। আশির দশকে ওদের দোকান উঠে যাওয়ার পর থেকে ওরাও আজ শুধুই স্মৃতির শহরেরই বাসিন্দা।
বাংলামোটর-পরিবাগ পার হওয়ার সময় কিছু দোকান-পাট দেখবেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র খুঁজে লাভ নেই, ওটা এখনও আমাদের সময়ের সবচেয়ে আলোকিত মানুষের স্বপ্নেই আছে। উনি হয়ত এখন ইন্দিরা রোডের বাড়ির ভাড়া নিয়ে দরদাম করছেন, স্বপ্নের যাত্রা শুরু হলো বলে। একটু এগুলেই কিছু দামি সরকারি কলোনি আর তারপরেই আমাদের সবেধন নীলমনি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল। শেরাটন গ্রুপ ওটা কেনার কথা হয়ত মাত্র ভাবা শুরু করেছে। রেস্তোঁরা কাম বার সাকুরা একদম পাশেই, দীর্ঘদিন ধরে সুখাদ্য আর পানীয় বেচে বেচে ওরা এই তিলোত্তমা শহরের এক সিম্বল হয়ে গিয়েছে। কাছের রমনা পার্কও সমাজবিরোধীদের দখলে যায়নি, ওটাও বেশ পারিবারিক জায়গা, মাঝে মাঝে সপ্তাহান্তে আমাদেরও বেশ ভ্রমণ হয় সেখানে।
শাহবাগের মোড়ে এসেছেন? মোড়ের হাসপাতালটা লোকে পিজি হাসপাতাল বলে, ওটার নাম যে এককালে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হবে সেই ধারনা রাস্তার কোনও লোকেরই নেই। বছর দুয়েক আগে বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ পড়েছিল তাঁর স্মৃতিময় দোতলা বাড়ির সিঁড়ির ঘরে, কাছেই শুয়ে ছিলেন তাঁর অতি প্রিয়জনেরা, শুয়ে ছিল আমার থেকে একটু বড় ভয়ার্ত এক বালক। এই নিষ্ঠুর ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা তখনো নিজেদের বিপ্লবের নায়ক ভাবছে, ভাবছে জার নিকোলাসকেওতো সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল, রুশ বিপ্লবের নায়কেরা কি খলনায়ক হয়েছে? আমার শহর সেই গ্লানিবহন করে চলেছে তখনো। শহরে কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা পাওয়া যাবেনা। শাহবাগের কাছেই একটা বিলবোর্ডে ঘষে ঘষে ওঠানো হয়েছে শেখ মুজিবকে। ভালোমত লক্ষ্য করলে চেনা যায় তাঁকে। মুজিবকে এই শহরে পেতে হলে দৃষ্টি নয়, অর্ন্তদৃষ্টি থাকতে হবে, তিনি নির্বাসিত এখান থেকে, পুরানো ময়লা টাকা ছাড়া আর কোথাও নেই তিনি। নেই তাঁর স্মৃতি বিজড়িত রেসকোর্স, তাঁর বাসভবনে আছে কবরের নির্জনতা, রাষ্ট্রের প্রহরী সেখানে পাহারা দেয় অষ্টপ্রহর। কয়েক বছরের পুরানো সিনেমার কোর্ট সিনে দেখতে পাবেন জজসাহেবের পেছনটা ঘষটানো, ওখানে মুজিবের ছবি ছিল যে। মানুষকে কি এত সহজে মুছে ফেলা যায়?
রিকশা চলছে এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে, কাঁটাবন পেরিয়ে। মনোহারি জিনিসের দোকানটা কী বস্তু সেটা আমার মাথায় ঢুকতো না, কিন্তু এলিফেন্ট রোডের দোকানগুলো মনে হত আসলেই মনোহারি জিনিসের দোকান। বিয়ের কুলো, পায়ের জুতো, বিদেশি প্যান্ট, বেল্ট, লাইটার কী নেই? কে বলবে এই রাস্তায় একসময়ে হাতির যাতায়ত ছিল। আবার তুলে ধরছি “স্মৃতি-বিস্মৃতির শহর” বইয়ের পাতা।
ঢাকায় এক সময় হাতির আধিক্য ছিল খুব। সরকারি পিলখানা ঢাকায় থাকাও এর একটি কারণ হতে পারে। নদীতে হাতি গোসল করানোর জন্য নির্দিষ্ট কোন জায়গা ছিল না। ১৮৬৪ সালে, পৌরসভা স্থাপনের আগে, লেফটেন্যান্ট গভর্ণর ঢাকায় এলে, ঢাকা কমিটির সদস্যরা জানিয়েছিলেন, হাতিরা শহরে সৃষ্টি করছে “সিরিয়াস ন্যুইসেন্সের”। এ পরিপ্রক্ষিতে খুব সম্ভব বিস্তীর্ণ রমনা এলাকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল হাতি চরাবার জন্য। পিলখানা থেকে রমনায় হাতি নেওয়ার জন্য যে পথটি ব্যবহৃত হতো কালক্রমে তাই পরিচিত লাভ করেছিল এলিফ্যান্ট রোড নামে।
এসে গেছি সাইন্স ল্যাব, আমার দ্বিতীয় বাসভবন। আমার জন্ম এর থেকে দূরে নয়, দূরে নয় স্কুলের মাঠ, দূরে নয় কলেজের চত্বর, দূরে নয় বড় হওয়ার গল্পগুলোও। এখানে আমি একদম সপ্রতিভ, জলের মধ্যে মাছের লেখাজোখার মতই সাবলীল আমি। রশীদ ভাইয়ের হাতটা ছেড়ে দিলেও আমি হারিয়ে যাবো না। আর হারালেই বা কী, সামনেই দেখতে পাচ্ছি সাইন্স ল্যাবরেটরি পুলিশ বক্স। টুক করে ঢুকে পড়ে বাসায় ফোন দিয়ে দেব।
রিকশা কি ধানমন্ডি যাচ্ছে? আমরা তো বলিনি কিছু। স্মৃতির শহরের রিকশাওয়ালারা আবার অন্তর্যামী। ওরা জানে কোথায় যেতে হয়। পার হয়ে গেছি ধানমন্ডি মাঠ, এই দুপুরেও সেখানে খেলা চলছে। আট নম্বর রোড দিয়ে ঢুকে ব্রিজটা পেরুতেই ধানমন্ডি লেক, দুপাশে সবুজ ঘাসের গালিচা। ইতঃস্তত ঘোরাঘুরি করছে কিছু স্বাস্থ্যপ্রেমী মানুষ। কী আশ্চর্য, আজ রিকশাওয়ালা আমাকে ঘুরিয়ে এনেছে আমার শৈশবের পরিসীমা, আমার সীমাবদ্ধ জগতটাকে। এই লোক কি পিসি সরকারের কেউ হয় নাকি?
একটু বাতাস নেই লেকের। পানিতে প্রচুর সাপ আছে। আমি আমার নানার সাথে বেড়াতে যেতাম লেকের ধারে। সাপ দেখে আঁকড়ে ধরতাম তাঁর হাত। উনি অভয় দিতেন, এগুলো নাকি ঢোড়া সাপ, কোন উচ্চবাচ্য নেই ওদের। কথাটা ঠিকই, আজ লেক থেকে উৎখাত হয়েছে ওরা সমূলে। হরলিক্স খাওয়া বাচ্চার মত স্বাস্থ্যবান সাপ খুঁজে পাওয়া বড় দুষ্কর। অল্প কয়েক বছর আগে লেকের পাড়ে একটা আধমরা সাপ দেখে আমার রীতিমত দুঃখ হয়েছিল সেই শৈশবের ভীতিপ্রদ প্রাণীদের জন্য। বেচারারা নির্বিষ ছিল দেখেই কি নির্বংশ হলো?
ফিরবেন বাসায় নাকি থেকে যাবেন লেকের পাড়ে? আপনার ইচ্ছা। তবে শৈশবের শব্দ, গন্ধ আর ছবি বুকে মেখে নিয়ে ফিরে আসতেই হবে এই পোড়া পোড়া গন্ধওয়ালা বাস্তবে, ফিরলেই ঘিরে ধরবে নানান ধান্ধা আর যাবতীয় মিথ্যা সব কাজ। কিন্তু এরপরও বুকের মাঝে যেই চিনচিনে ব্যথাটা লাগছে, সেটা কিন্তু ব্যথা নয়, একটুকরো আনন্দ। ওইখানটাতেই আছে আপনার স্মৃতির শহর। শীতের পাতা ঝরা দিন অথবা বসন্তের ঝলমলে সকাল, অথবা ঝমঝম বর্ষা সবই পাবেন দশ মিনিটের সফরে, বেড়ানোর এমন জায়গা কি আর কোথাও আছে? কী আশ্চর্য স্মৃতির শহর!!!
No comments:
Post a Comment