দিনটা এখনো শুরু করিনি। আমার বাসার কাজের টেবিলে সকালের রোদ্দুর এসে পড়েছে, জানালা খুলতেই একঝাঁক ঠাণ্ডা বাতাস মুখে এসে পড়ে, বাইরের মাঠে স্বাস্থ্যপ্রেমীদের ছোটাছুটি, পাখিদের ডাকাডাকি, ফুলের সৌরভ -- সর্বত্রই দিনশুরুর প্রস্তুতি। ওরা সবাই মিলে ডেকে আনে আমার বালকবেলা, সেই উনত্রিশ নম্বর বাড়িতে আমি পৌঁছে যাই এক নিমেষে।
স্মৃতির দিনগুলো ঝকঝকে হয়, মলিনতা ঝেড়ে ওরা সর্বদাই তরতাজা। ওখানে আব্বা রীতিমত যুবক পুরুষ, সকালে গুনগুন করে গান করেন, নাস্তার টেবিলে টুকটাক আলাপ করেন আর অজান্তেই জীবনদর্শন ঢুকিয়ে দেন মাথার মধ্যে। রান্নাঘর থেকে রেশমি ধোঁয়া উড়ছে, মিষ্টি গন্ধটা ফুলের নয়, মিষ্টি কুমড়া নিয়ে তৈরি সব্জির। আর ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দটাতেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ওটা পরোটা ভাজার শব্দ। দূরে কোথাও সাগর সেন গাইছেন -- “তুমি এপার-ওপার করো কে গো ওগো খেয়ার নেয়ে ...”, এই সকালের চলচ্চিত্রে ব্যাকগ্রাউণ্ড সঙ্গীতের মত ছড়িয়ে পড়ে তাঁর অপূর্ব কন্ঠের ব্যাকুলতা। এই আশ্চর্য ভোরবেলাটা যেন বিস্মৃতির আড়াল থেকে উঠিয়ে আনে একমুঠো স্মৃতির শহর। সেই শহরে আর ফের হয়না -- তার অপার্থিব সৌন্দর্যের জলছবি দেখি শুধু।
বারান্দায় বসে আছে বোকা চেহারার হাঁ-করা একটা কাক, যেটাকে আমার বড়ভাই ডাকেন—স্টুপিড কাক। উনিও উঠে পড়েছেন। একটু পরেই বাথরুম থেকে বেরুবেন, লম্বা চুল আঁচড়ে। আব্বার সাথে একদফা ঝগড়াও হয়ে যেতে পারে -- নানান বিষয়-টিষয় নিয়ে। উচ্চস্বরে কথা বলাটা আমাদের সবার জন্মগত ত্রুটি। আমাদের ঐকমত্যের ভিত্তি করা আলোচনাও ঝগড়া বলে মনে হতে পারে। টিভিতে সকালের খবর হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির গতকালের দিনলিপি দেখছি, উনিও এখন হয়ত একটু পরেই রেডি হয়ে আজকের শ্যুটিং-এ বের হবেন। আচ্ছা ওনাদের কি ভালো লাগে এই বাক্স দখল করে বসে থাকতে?
কাকডাকা ভোরে উঠে আমার মেজভাই পড়তে বসেছেন, ফিটফাট, রুটিন মেনে জীবন-যাপন করেন সেই শৈশব থেকেই। তাঁর উপর স্কুলের স্যারেরা খুবই প্রসন্ন, হয়ত মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করবেন। উনিও এসে বসেছেন নাস্তার টেবিলে। এসে গেছে আজকের খবরের কাগজ। সেখানে আছে মিথ্যা প্রেসনোটসহ আরো ঝুরি ঝুরি রাষ্ট্রীয় মিথ্যাভাষণ। আমরা সবাই পয়সা খরচ করে মিথ্যে কথা পড়ি, শুনি এবং দেখি। আম্মাও এসে গেছেন নাস্তার টেবিলে, বাজারের ফর্দ রেডি, আমাদের খাইয়েই আলো ছুটবে কাওরান বাজারে।
আমাদের আলোচনার বিষয় হয় রাজনীতি অথবা রসাতলে যেতে থাকা এই দেশ অথবা তেজগাঁ স্টেশন রোডের অধঃপতন। দেশ-কাল-সমাজ -- সর্বত্রই এক পচনশীল চিত্র, যা হয়ত আজও রয়ে গেছে অপরিবর্তনীয়। এর থেকে আমাদের মুক্তি কিভাবে হবে? সমাজতন্ত্র? গণতন্ত্র? নাকি অন্য কিছু? কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনও আর জানা হয় না।
আমিও আছি সেই আলোচনায় হয়ত শ্রোতার বেশে। হয়ত স্কুল কামাইয়ের নতুন অজুহাত খুঁজছি, বগলের নিচে রসুন দিলে কোন কাজ হয় না, সেটা যেই-ই বলুক না কেন। রেডি আছে “চারমূর্তির অভিযান”, সবাই চলে গেলে আমি টেনিদার সাথে ডুয়ার্সের জঙ্গলে যাবো। যাবার জায়গার অভাব নেই, সূর্যদেবের বন্দীদের একটু পরেই ভাজা হবে, টিনটিনের এইবার খবর আছে!! নেতাজী সুভাষ বোস কি পালাতে পারবেন গোয়েন্দা আর পুলিশের চোখ এড়িয়ে? অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ বই “রাত ভ'রে বৃষ্টি” পড়ে নেব একটু খানি, নিষিদ্ধ জিনিসের মজাই আলাদা। আবাহনী কেনোই বা ইস্টএন্ডের মত দলের সাথে ড্র করে পয়েন্ট হারায়?
বাসায় থাকলে দিনগুলি অনেক অনে--ক লম্বা মনে হয়। গল্পের বই, পাড়া বেড়ানো, আমার পোষা কুকুর জো-এর সাথে খেলা করার পরেও অনেক সময় রয়ে যায়। আচ্ছা স্কুলে গেলে এত তাড়াতাড়ি সময় কেটে যায় কেন? পুরো স্কুল জীবনটাই মনে হয় হুশ করে কেটে গেল, এক লহমায়।
স্কুল গেলেও মন্দ হয় না আজ, পড়াশুনা শিকেয় উঠেছে অনেকদিন। পড়াশুনাটা ওখানে মুখ্য নয়, ওখানেও আছে একরাশ আনন্দের ভাণ্ডার। তবে মনের এক কোনে পড়া নিয়ে ভয়ও আছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে খবরের কাগজে এইরকম অনেক বিজ্ঞপ্তি আসতো...
বাবা সুমন, তুমি যেখানেই থাক ফিরে এসো। তোমার চিন্তায় তোমার মা শয্যাশায়ী। তোমাকে বাসায় কেউ কিছু বলবে। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর সুমন ছেলেটা ঢাকার গোপীবাগের বাসা থেকে হারিয়ে গেছে, কোন সহৃদয় ব্যক্তি তার সন্ধান পেলে...সুমন বাংলায় কথা বলে।
আমি আতঙ্ক নিয়ে এইগুলো পড়ি, হয়ত ভবিষ্যতে কোনো একদিন আমার জন্য এরকম বিজ্ঞপ্তি আসবে পত্রিকাতে। সেই ভয়েই কি একদিন পড়তে বসে গেলাম?
আজ এই সকালটা কেন যেন বিস্মৃতির অতল থেকে ডেকে আনে আমার ফুটবল খেলার মাঠ, সকালবেলার তাড়াহুড়া, দুপুরবেলার ক্লান্তি, বিকেলের হট্টগোলগুলো। আর সবাইকে পেছনে ফেলে সামনে চলে আসে বালক এক --সালাহউদ্দীনের মত ফুটবলার হতে পারে সে, হতে পারে বৈমানিক, হতে পারে আইসক্রিমওয়ালা, হতে পারে কবি, তার স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরা পায়ে ধূলো মাখা, চোখ তার চকচক করছে আবিষ্কারের নেশায়, চুলগুলো এলোমেলো...বিশাল এক পৃথিবী ডাকছে তাকে ...আর আমার বাড়তে থাকা মধ্যপ্রদেশ, কমে যাওয়া চুল, রিডিং গ্লাস, নিয়মিত ঔষধ সেবন-- আমাকে কি ও আর দলে নেবে?
অতিদূর থেকে আমি চাতকের মত ব্যাকুল তাকিয়ে রই বালকবেলার পানে...
ভাঙিলে হাট দলে দলে সবাই যাবে ঘরে চলে
আমি তখন মনে ভাবি, আমিও যাই ধেয়ে ।।
দেখি সন্ধ্যাবেলা ও পার-পানে তরণী যাও বেয়ে
দেখে মন আমার কেমন করে, ওঠে যে গান গেয়ে
ওগো খেয়ার নেয়ে।।
No comments:
Post a Comment