“পাপু দেখ দেখ...একটা পুকুর...”
'কেন তুই জানতি না? ওটার মাঝখানে একটা শেকল আছে, সাঁতরে নেমে বেশি দূর গেলে...'
“এই স্টুপিড দুইটা...তোরা আবার বকর বকর...” স্যারের গর্জনে আমার আর জানা হয় না। শেকলের রহস্য রহস্যই থেকে যায়। আমাদের ক্লাস ওয়ান থেকে থ্রি ছিল ল্যাবরেটরি স্কুলের একতালায়, দোতালায় এই প্রথমবার ক্লাস করছি আমরা। অপার বিস্ময় নিয়ে যেন এক অজানা পৃথিবী দেখছি। দোতালার ক্লাসের জানালা দিয়ে স্কুলের মাঠে মেঘের ছায়া দেখে মুগ্ধ হই, তেমনি অবাক হই গ্রীষ্মের বা রোজার ছুটির পরে স্কুলের মাঠ ভর্তি সাদা কাশফুল দেখে।
স্যার চলে যেতেই জুনায়েদ উঠে দাঁড়ায়, ক্লাসের সামনে এসে ঘোষণা দেয় যে সে একটা চুটকি বলবে।
“এই শোন...একটা লোক হাগতে বসছে...হা হা হা...লোকটা হচ্ছে আতাহার হোসেন স্যার...”
এই চুটকি শুনে আমাদের হাসতে হাসতে পেটে প্রায় খিল ধরে যায়। আমাদের সেই সময়ে অল্প বয়েস থেকে খারাপ কথার চর্চা হতো, এতে নাকি মনের চাপ কমে যায়!! আমরা যুদ্ধের পরের প্রজন্ম, কারও ঘরেই তেমন প্রাচুর্য নেই, দুর্ভিক্ষ আর সামরিক শাসন দেখে দ্রুত বড় হচ্ছি, মাসের শেষে সবার বাবারই পকেট প্রায় ফাঁকা, শৈশবেই রেশনের দোকানে লাইন দিতে হতো অনেককেই।
আমাদের প্রিয় স্বদেশ তখন উদ্ভট উটের পিঠে উঠে এক আজব দেশে যাচ্ছে। খেলার মাঠে দৌড় দেওয়া আর আজগুবি সব গল্প এটাই সবচেয়ে বড় বিনোদন সেই সময়ে। তবে এই বিনোদনকে অতিক্রম করার মত অন্যকিছু আজও তৈরি হয় নি। পড়া লেখাতে অধিকাংশের অবস্থাই শোচনীয়, পড়া জিজ্ঞেস করলেই অনেকের মুখেই নির্ভেজাল বিস্ময়ের দেখা মিলত। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “অমলকান্তি” কবিতার এই কয়টা লাইন পড়লেই আমার শৈশবের বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যায়।
অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারতো না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
তবে অমলাকান্তিদের ভিড়ে ভয়াবহ জ্ঞানী ছেলেরাও আছে কিছু, যাদের জন্য এই স্কুলটার অনেক সুনাম ছিল একসময়ে।
পড়া ধরলে আমাদের একেকজনের একেক রকম অভিব্যক্তি দেখা যেত, যেটা বড় হয়ে আমাদের আড্ডায় বিনোদনের ব্যাপার ছিল। অমিকে পড়া ধরলে, ও স্যারকে প্রশ্নটা আরেকটু বিশদ করে বলার জন্য অনুরোধ করত। স্যার বুঝিয়ে বললে ও জানাত যে ওর উত্তর জানা নেই, এটা করলে নাকি মারটা কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যায়। আজিজকে পড়া ধরলে বিনা উস্কানিতে ও হাউমাউ করে কাঁদত। পাপু একবার স্যারকে পড়া ধরার পরে বলেছিল, যেই শাস্তি আপনি দেবেন আমাকে (ব্যাঙ হয়ে কান ধরা), সেটা স্যার আমি বাসায় প্র্যাক্টিস করে এসেছি। অতনু টপাটপ ফার্স্ট হয়ে যেত, পড়ার উত্তরও দিত নির্দ্বিধায়। কিন্তু একটু বড় হওয়ার পরে ও আর আমি একই সঙ্গে কান ধরে উঠবস করেছি, আনাওয়ারুল করিম স্যারের সৌজন্যে, সঙ্গদোষে লোহাও নাকি ভাসে।
আমার বন্ধুদের মধ্যে আরশাদ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। অসাধারণ রসবোধ আর পুরানো ঢাকার অশ্লীল গালিগালাজ দিয়ে সে জমিয়ে রাখত চারপাশ। গালাগালির পাশাপাশি সিগারেট খাওয়াতে অতি অল্প বয়েসেই সে দক্ষতা লাভ করে। আপনারা নিশ্চয় ওর উন্নতির কার্ভটা দেখছেন? এই তিনটি বিষয়ে আমার উৎসাহের পেছনেও ওর অবদান রয়ে গেছে। মানুষের বিপদে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ঝাঁপিয়ে পড়া অকৃতদার এই মানুষটাকে নিয়ে মনে হয় এক মহাকাব্য লেখা যাবে।
আরশাদের পরেই আসে লোদীর নাম। গালাগালে ওকে রানার্স-আপ বলা যায়। এছাড়া অশ্লীল ছড়া-গান, স্যারদের নকল করে দেখানো -- এই সমস্ত বিষয়ে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। অফিস পাড়াতে এই ছিমছাম, মোটাসোটা মাঝবয়েসি ভদ্রলোককে দেখতেও থাকতে পারেন আপনারা, সৌজন্যের আড়ালে শৈশবের বিচ্ছু ছেলেটা চাপা পড়ে গেছে কোথায় যেন।
স্কুলের সামনে একটা ঝকমকে রিকশা দেখতে পাবেন। ওটার পেছনে বড় বড় লাল হরফে লেখা আছে “প্রাইভেট”। ঢাকার সোওয়ারিঘাট থেকে আমাদের বন্ধু আজিজ ওটা চেপে রোজ স্কুলে আসে। ওটার গায়ের ঝালরগুলো প্রায় নতুনের মত, সিটের নিচে একটা বাহারি রেডিও ফিট করা আছে, সামনে স্লাইডিং গ্লাস উইন্ডো। আমি আমেরিকাতে এসে “ফুল্লি লোডেড” গাড়ি দেখার পর বুঝতে পেরেছি যে আজিজের রিকশাটা “ফুল্লি লোডেড” ছিল। তবে রিকশাওয়ালা অতি বজ্জাত ছিল, আজিজ ছাড়া আর কেউই চড়তে পারত সেই রিকশাতে। আমার এখনও গোপন বাসনা ওই রকম একটা রিকশা কেনা। নিজে চালালে মেদও কিছু কমতে পারে।
আমাদের প্রথম তিনটা শ্রেণীতে ছিল মাত্র চারটা পিরিয়ড। স্কুলে টিফিন দিত, সেই পরোটা আর ভাজির স্বাদ আমি আজও ভুলতে পারি নি। একটু বড় হওয়ার পরে আমরা টিফিন পিরিয়ডে দলবেঁধে বাইরে যেতাম খেতে। স্কুলের উলটো পাশেই ছিল “চিটাগাং রেঁস্তোরা” আর “ঢাকা স্ন্যাক্স” । চিটাগাং হোটেলে গেলে আমরা খেতাম কিমা পরোটা, সত্যিকারে কিমার তৈরি, রীতিমত মোটাসোটা সাইজ ছিল ওদের। এর সাথে দিত সামান্য সালাদ। অতি দ্রুত শেষ করতে হতো, শকুনের মত বন্ধুবান্ধব আমার, কারও আগে শেষ হলে সে হামলা করবেই। কালক্রমে আমি নিজেও এক শকুনে পরিণত হয়েছি, এখন আমার খাওয়া আগে শেষ হলেই সেটা অন্যের জন্য ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
একটু বড় হয়ে আমরা টিফিনের সময়ে আরো দূরে যাওয়া শুরু করি। সায়েন্স ল্যাবের মোড়ে ছিল মালঞ্চ স্যাক্স, ওদের কলিজা সিঙ্গাড়া আর সমুচা অমৃতের মত লাগা শুরু করল আমাদের কাছে। আর মাঝে-সাঝে ধানমন্ডি পাঁচ নম্বর রোডের মহানগরী সবজি ঘরে কোন আইসক্রিম খেতে যেতাম আমরা। কোন আইসক্রিম ঢাকাতে নতুন এসেছে তখন, আমার মনে হতো এই আইসক্রিমের আবিষ্কর্তাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত।
দূরদূরান্তে যাবার কারণে টিফিন টাইম পার হওয়ার পরে স্কুল ঢুকতাম আমরা। দুই একজন করে করে লুকিয়ে ক্লাসে ঢুকতে হতো, এটাই ছিল বিরাট এ্যাডভেঞ্চার। তবে ব্যাপারটা হেড স্যারের নজরে আসায় উনি একদিন সবাইকে হাতে-নাতে ধরেন এবং শাস্তির ব্যবস্থা করেন। তবে ততদিনে শাস্তিতে আর কাজ হতো না।
আমরা প্রায় সবাই বই পড়তাম, টেলিভিশনের চ্যানেল ছিল মাত্র একটা, সেটাই দেখা হতো। সবার মানসিকতাই ছিল কাছাকাছি ওয়েভ লেংথে। সবারই প্রিয় বইগুলো বের হয়েছে সেবা প্রকাশনী থেকে, নাইজারের বাঁকে, মরুশহর অথবা কার্পেথিয়ান ক্যাসেল নিয়ে আলোচনা করে ক্লাসের ভেতর ও বাইরেটা কেটে যেত। একবার কয়েকবন্ধু মিলে দলবেঁধে গিয়েছিলাম সেগুনবাগিচার সেবা প্রকাশনীতে। স্মৃতির শহরে কাজীদার চেয়ে উজ্জ্বল উপস্থিতি খুব কম মানুষেরই আছে।
ক্লাস টেনে ওঠার পর থেকে আমাদের কনসার্টে যাতায়াত শুরু হয়। ঢাকায় তখন ব্যান্ড সঙ্গীত তরুণদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। আমাদের প্রজন্ম সেই উত্তাপের বাইরে নয়। আমাদের বন্ধু টিপু তখন সদ্য মাস্তানিতে হাত পাকাচ্ছে, ওর জীবনের লক্ষ্যও স্থির করেছে...”ডেরাগ ডিলার” হতে চায় সে। কনসার্টে মারামারি করাটা ওর “জব ডেসক্রিপশনের “ অন্তর্গত মনে করে সে । “গ্যাঞ্জাইম্যা” না হলে ঠিক “কুল” হয় না ব্যাপার-স্যাপার। দুঃখের বিষয় প্রায় প্রতিটি কনসার্ট টিপুর একদফা প্রহার হজমের মধ্যে দিয়ে শেষ হতো। বড় হয়ে টিপু একই ভুল পথে হাঁটতে থাকে এবং আজ থেকে বছর দশেক আগে আমেরিকার এক জেলের সেলে নিঃসঙ্গ মৃত্যুবরণ করে সে। বিশালদেহী প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হাসিখুশি এই ছেলেটার জীবনটা শেষ হয় শুধুই ভুল পথে হেঁটে হেঁটে।
আমাদের আরেকটা বিশুদ্ধ বিনোদন ছিল ফুটবল খেলা। স্কুলের মাঠ থেকে ঢাকা স্টেডিয়ামে সবর্ত্রই তখন ফুটবলের জয়জয়াকার। আবাহনী আর মোহামেডানের খেলাতে গ্যালারি উপচে পড়ে ভীড়ে। দু'জনেই সমান সমান। আমাদের প্রিয় আবাহনীতে তখন সালাহউদ্দীন, চুন্নু, আসলামদের স্বর্ণযুগ চলছে, ভারতের গোলরক্ষক অতনু ভট্টাচার্যকে পরাভূত করেছেন আসলাম ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া আচমকা শটে। উনি সম্প্রতি নিজের এই আচমকা গোল দেওয়ার অভ্যাসটাকে ফ্যাবিয়ানোর সাথে তুলনা দেওয়াতে অনেক হাসাহাসি হতে দেখেছি, কিন্তু আমার মনে উনার সেই গোল ভাসছিল বলে কথাটাকে আর বড়াইয়ের মত লাগে নি। আবাহনী ইরাক থেকে বিশ্বকাপ তারকা প্লেয়ারদের এনেও হেরে গেছে মোহামেডানের কাছে, দুবার এগিয়েও জিততে পারেনি। ক্লাস শুরুর আগে এই নিয়ে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে বচসা হয়। খেলায় যেই জিতুক না কেন কোন অজানা কারণে বচসার পরে আমাদের বন্ধু আবিদকে আচ্ছা করে ধোলাই দেওয়া হতো, গুলগল্পের কারিগর আবিদের ঘড়িতে নাকি অক্সিজেন ঢুকানো আছে, সে মার খেয়ে শ্বাস নেয় সেখান থেকে। আমরা স্কুল থেকে বাড়িতে ফেরার সময়ে রাস্তায় মোড়ে মোড়ে ওড়া আবাহনীর নীল আর মোহামেডানের সাদা-কালো পতাকাগুলো গুনতাম, যারটা বেশি তারাই নাকি জিতে...কলরবময় দিনগুলো স্বপ্নের মত কেটে যায় শৈশব আর কৈশোরের বারান্দায়।
সেই বালকদের কোলাহলগুলো যেন স্বপ্নের ওপার থেকে ভেসে আসে কোন কোন সকালে, ওদের সবার চোখে দেখতে পাই বিস্ময়, পৃথিবীর পাঠশালায় এই সময়টাই যেন আশ্চর্য হওয়ার সময়। এরপরে পৃথিবীকে দেখার সেই চোখটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এই বালকরা আজ সবাই এখন ধূসর ভদ্রলোক, সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষ, নানান সামাজিকতার নিচে চাপা পড়ে গেছে শৈশব। তবুও হয়ত নানান কাজের ফাঁকে জীবনের ধূলো ময়লাগুলো ঝেড়ে ফেলে এরাও হয়ত ঘুরে আসে অনেক দূরের সেই শহরে, সবার অলক্ষ্যে...দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে দূর থেকে দেখে বালকবেলার কোলাহল। এ বড় মোহনীয় দৃশ্য...
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণে কাক ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামফলের পাতায়
যা নাকি অল্প একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
No comments:
Post a Comment