Friday, November 26, 2010

স্মৃতির শহরঃ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ

বাংলাদেশ আর আমি প্রায় সমবয়েসী। আমাদের জন্ম কাছাকাছি সময়ে, আমরা বেড়েও উঠেছি প্রায় একই সঙ্গে। আমি যেবার স্কুলে ভর্তি হই, তার কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশকেও ভর্তি করা হয় সেনাবাহিনীর পাঠশালায়। আমি কলেজে ভর্তি হতে হতে বাংলাদেশে সামরিক শাসনেরও দশ বছর পূর্ণ হয়ে গেছে, আর আমি যখন কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা জীবনে পা রাখলাম, বাংলাদেশও তখন সামরিক ভূত গা থেকে ছেড়ে গনতন্ত্রের দিকে পা বাড়িয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আমার চোখ দিয়ে যেন বাংলাদেশের স্বপ্নই দেখি।

যেই স্বপ্ন নিয়ে আমরা দুজনই জীবন শুরু করেছিলাম, সেই স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস শুরু হতে জন্মের পরে আর বেশিদিন লাগেনি। আমার এই লেখাটা আমার বাংলাদেশকে নিয়ে, বালক এবং কিশোরের চোখে দেখা স্বপ্নভঙ্গের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের মূল সুর থেকে সরে আসার গল্প। আমি কোন ইতিহাস বলতে চাইছি না, না কোন গবেষণা প্রবন্ধ, এটা শুধু আমার নিজের অভিমানের গল্প। এই গল্পে নতুন কোন অজানা তথ্য নেই।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভর্তি হই আমি স্কুলে। ভেবে দেখবেন সময়টা, মাত্র কয়েকমাস আগেই বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন তাঁর নিজের বাসায়, নিজের দেশের সেনাবাহিনীর একাংশের হাতে। সেনাবাহিনীর আরেক অংশ যে খুব বাধা দিয়েছিল তা নয়, মনে হয় সবাই মনে করেছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলাই বোধহয় তাঁর প্রাপ্যই ছিল। অল্প কয়েকদিন পরেই জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছেন সিপাহী জনতার বিপ্লবে, দেশে শৃংখলা ফিরে এসেছে, বহু প্রত্যাশিত শান্তি যেন পাওয়া গেছে।

মুজিব যখন নিহত হন, তখনও জেলে আটকা পড়ে ছিল অনেক যুদ্ধাপরাধী। এত মানুষকে হত্যা করেও একজনকেও ঝুলতে হয়নি ফাঁসির দড়িতে। জেলে ঢুকে এদের অনেকেই প্রাণে বেঁচেছে, নইলে হয়ত মুক্তিবাহিনীর হাতেই জীবন শেষ হত ওদের। মুজিবের সাধারণ ক্ষমা ছিল শুধু “পাতি রাজাকারদের” জন্য, কিন্তু বড় রাজাকারগুলোকে কেন তিনি জেলের ভেতর পালছিলেন, সেটা আমার বোধগম্য হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ার প্রথম দোষটা আমি বঙ্গবন্ধুকেই দেব। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এদেরকে শুধু ছেড়েই দিলেন না বরং ধীরে সুস্থে বেশ প্রতিষ্ঠিত করলেন তাদের। জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন শাহ আজিজ, যিনি একজন স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন, গোলাম আযমও দেশে ফেরে একই সময়ে। এত কিছু সত্ত্ব্বেও মানুষ কিন্তু ভুলেনি মুক্তিযুদ্ধকে। তখনো পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধও কোন দূরের কোন ঘটনা নয়, মানুষের মনে তার স্মৃতি বেশ ভালো ভাবেই জেগে ছিল।

আমাদের ক্লাস ওয়ানের পঁয়ত্রিশ জন ক্লাসমেটের মধ্যে দুজন আছে যাদের বাবা মারা গেছেন যুদ্ধে। আমরা সবাই তাদের সমীহ নিয়ে দেখতাম, শিক্ষকরা স্নেহ করতেন বেশ, মাঝে মাঝে এগুলো নিয়ে কথা বলতেন। মনে আছে কয়েক বছর পরে ক্লাস ফাইভে উঠে নজরুল ইসলাম স্যার বেশ জোর করে ওদের ফ্রী স্টুডেন্টশীপ করে দেন, ওরা অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান, ওরা যথাসাধ্য আপত্তি জানালো, সরকারি স্কুলে বেতনই বা কতো। কিন্তু স্যার নাছোড়বান্দা, শেষে উনি বললেন, “বাবা, তোদের জন্য কিছু করতে পারলে আমার নিজেরই ভালো লাগবে, আমার জন্যই তোরা এটা নে।”

আমরা স্কুলের মাঠে বসে শুনেছি আমার শহীদ পরিবারের বন্ধুদের বাবাদের বীরত্বের গল্প। এঁদের একজন ছিলেন বিমান বাহিনীর তরুন অফিসার, তাঁকে গুলি করে হত্যা করে তাঁরই এক সহকর্মী। তাঁর স্ত্রী, স্বামীকে হারান খুব অল্প বয়েসে, দুটি ছোট বাচ্চা নিয়ে প্রায় অকূল পাথারে পড়েন তিনি। বাংলাদেশ বিমানে একটা চাকরি করতেন খালাম্মা, তাঁর মেয়েটাকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে দিয়েছিল, যক্ষের ধনের মত তিনি ছেলেটাকে মানুষ করছিলেন। ধরা যাক এই ছেলেটির নাম বারেক, আমার শৈশবের সহপাঠী। আমরা বা আমার বাকি সহপাঠীরা আজও ভুলিনি ওদের সেই কষ্টটা।

জিয়া নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, বীরোত্তম ছিলেন, এতগুলো বিশেষণ থাকার পরেও কেন তিনি দেশকে পাকিস্তানের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন? আমার কাছে মনে হয়েছে কারণটা হয়ত পুরোটাই রাজনৈতিক, তিনি আওয়ামী লীগের বিপরীতে একটা প্ল্যাটফর্ম গড়তে চেয়েছিলেন, জাসদ একটা দাঁড়ানো প্ল্যাটফর্ম ছিল কিন্তু মুসলিম প্রধান দেশে জাসদের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা “পাবলিক খাবে না”, তাই ইসলামকেই পুঁজি করলেন তিনি, যদিও তাঁর ক্ষমতায় আরোহনের পিছে জাসদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আদর্শ টার্দশ নিয়ে ভাবলে মনে হয় রাজনীতি হয় না।

জিয়ার আমলে নিউজ পেপার পড়লে ১৯৭১ সম্বন্ধে কোন কিছু জানাটা খুব জটিল ব্যাপার বলে মনে হবে। স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে পত্রিকাগুলো ক্রোড়পত্র বের করত ঠিকই, কিন্তু সেগুলোতে কখনও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বা রাজাকারদের উল্লেখ থাকত না তার বদলে “হানাদার বাহিনী” আর “তাদের দোসর” বলা হত। অনেকটা ভাসুরের নামের মত, উহ্য রাখা হত আসল ইতিহাস। সেই সময় পত্রিকা ছাড়া আর বইপত্র ছাড়া আর খুব কম উপায় ছিল ইতিহাস জানার, স্বাধীনতার উপর খুব বেশি বইও লেখা হয়নি তখন সুতরাং খুব আগ্রহী কেউ ছাড়া কারো পক্ষে সত্যিকারের ইতিহাস বের করা বেশ জটিল ছিল।

জিয়াউর রহমান অনেকগুলো সামরিক অভ্যুত্থান মোকাবিলা করেন, যেগুলো তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর হাতে দমন করেন। শোনা যায় তিনি সেনাবাহিনীর ভালো কোন অফিসারকে নেতৃত্বে রাখেন নি, পাছে তারা ক্যু করে বসে। লম্পট জেনারেল এরশাদকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা বোধহয় তাঁর সেই নীতিরই প্রতিফলন, যদিও এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে মনে হয় আমার। নিয়তির অনিবার্য পরিণতি একদিন জিয়ার ভাগ্যেও এল, স্ত্রী পুত্রকে ফেলে নিজের জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধ করা এই সমর নায়ক স্বাধীনতা বিরোধীদের যুদ্ধের দশ বছরের মধ্যে পুনর্বাসিত করে বিদায় নিলেন রঙ্গমঞ্চ থেকে। নেতারা আসেন আর বিদায় নেন, “কৌশলগত কারণে” স্বাধীনতা বিরোধীদের ব্যবহার করেন, নিজেরা প্রাণ হারালেও রাজাকারগুলো কালস্রোতে টিকে যায় তেলাপোকার মতই।

এরপর এরশাদের আগমন, একই পাকিস্তান তোষণ নীতি চলতে থাকল। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলটাও চিন্তা করতে হবে, সোভিয়েট ইউনিয়নকে আফগানিস্তানে নাস্তানাবুদ করেছে মুজাহীদিনরা আমেরিকার সাহায্যে। মৌলবাদীদের জয়জয়কার আর আমেরিকার পিঠ চাপড়ানিতে সারা দুনিয়া জোড়াই ওদের উত্থান। ইসলাম বেশ ভালো “মার্কেটেবল প্রডাক্ট”, সুতরাং লম্পট আদর্শহীন জেনারেল এরশাদ যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করবেন সেটা আর আশ্চর্য কি? এক রসিক বড়ভাই বলেছিলেন যে কয়েকদিন পরে নিউটনের সূত্রেরও মুসলমানী হয়ে যাবে, পড়তে হবে “বিসমিল্লাহ বলে কোন বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করলে, ইনশাল্লাহ তার ভরবেগের পরিবর্তন হবে”। রাষ্ট্রীয় মদদ পেলে যে কেউ আস্কারা পায়, আমার মনে হয় বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান জিয়ার আমলে শুরু হলে এরশাদের আমলে বেশ ভালো একটা অবস্থানে আসে এটা। স্যাম চাচাও বেশ খুশি এদের উপর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র জবাই হলে উনার কি যায় আসে? শিবিরের রগকাটা কার্যক্রমের শুরুও এই আশির দশকেই। যদিও এই মৌলবাদের “রিটার্ন মার্চেন্ডাইস” আমেরিকার কাছে ফেরার পর আজ ওরাই পয়লা নম্বর শত্রু হয়েছে আমেরিকার। আহারে, যদি আজকেরই এই বাস্তবতা থাকত সেদিন।

১৯৮৩ বা ৮৪ সালে বাংলাদেশ বিমানের পাইলটরা একবার ধর্মঘটে যায়। সেবার সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশানাল এয়ারলাইন্স থেকে কয়েকজন পাইলট এনে বিমান চালানো হবে। এ বিষয়ে পত্রিকায় একটা খবর দেখে চমকে উঠেছিলাম, এদের মধ্যে একজন পাকিস্তানি পাইলট আগে বিমানবাহিনীতে ছিলেন, হত্যা করেছিলেন একজন বাংলাদেশি অফিসার, আর কেউ নয় আমার বন্ধু বারেকের বাবাকে। শেষে কি হয়েছিল জানি না, কিন্তু অসীম ক্রোধ থেকে আমার সেদিন মনে হয়েছিল যে শুধু ইতিহাস বিকৃতি নয়, আত্মসম্মান পর্যন্ত এই জাতি বিলিয়ে দিচ্ছে।

এই রকম একটা পরিবেশে নয় মাসের যুদ্ধ ভুলতে বেশি দিন লাগার কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রথম প্রজন্মের আমরাও ভুলতে শুরু করলাম ১৯৭১ কে। খেলার মাঠে পাকিস্তান দলকে নিয়ে লজ্জাজনক মাতামাতি শুরু হয় আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে, সেবার একটা আন্তর্জাতিক হকি টুর্ণামেন্টের আয়োজন হয়েছিল। ১৯৮৮ তে একটা ক্রিকেট টুর্ণামেন্টে ব্যপকভাবে দেশের তরুন সমাজের পাকিস্তান প্রেম চোখে দেখা পড়ে। মজার ব্যাপার হল আশির দশকের শুরুতে চট্টগ্রামে পাকিস্তান টীম জনতার প্রহারের শিকার হয়েছিল (সেটা হয়ত দেশের জন্য কোন ভাল ঘটনা না), তার কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তান দলকে পূজা করার মত একটা বেশ বড় তরুণ গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেল, যারা অনেকেই আমারই বয়েসী। স্কুলে খেলার মাঠে গোল করে বসে মুক্তিযুদ্ধের গল্প করা প্রজন্মও আনমনে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে লাফ দেয় খেলার মাঠে, আমাদের সমসায়িক মেয়েরাও ইমরান খানকে চিঠি লেখে...খেলাতে নাকি রাজনীতি থাকতে নেই। কোনটা রাজনীতি, কোনটা আত্মসম্মান সবই আমরা ভুলে গেছি আশির দশকের শেষে এসেই।

এরপরের গল্প রেকারিং ডেসিমেলের মতই। নেতারা ইতিহাস ভুলিয়ে যা শিখিয়েছেন তাই আমরা শিখেছি। ইতিহাস বিস্মৃত আত্মসম্মানহীন জাতির জাতির ভাগ্য যা জোটা উচিত তাই জুটেছে। দুই দফা ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনাও যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন সেটা আমার মনে হয়নি, বরং তিনি জোর করে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা ঠিক মত উঠিয়ে আনলে যে মুজিব এমনিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান সেটা তাঁকে বোঝাবে কে? আজকে ব্লগগুলো পড়ে বুঝি যে নতুন প্রজন্মের অনেকেই দেশের সবচেয়ে সম্মানের ইতিহাসটা জানতে এবং জানাতে চায়, সেই সংগে নতুন বাংপাকি প্রজন্মও কিন্তু চোখে পড়ে। বাংলাদেশের সমবয়েসী এই আমার আর আগের ক্রোধ নেই, সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক, মেধা মননে উন্নত একটা দেশের প্রত্যাশা নেই আর, আছে শুধু স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। ইতিহাস ভুলে গেলে ভব্যিষৎও মনে হয় নড়বড়ে হয়ে যায়। আশির দশকে দেশে কোরবানীর সময় উট আমদানী দেখে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তাঁর অমর কবিতা “উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ”, মনে হয় আজও আমরা সেই উটের পিঠে চড়েই উলটোপথে যাচ্ছি।

উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায় ; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।
(উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ; শামসুর রাহমান)

No comments: