“আব্বু উইঠা পড়, সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে ।”
“হুমমম...”
“আব্বু ক্লাস মিস কইরা ফেলবা।”
“হুমমম...”
“উঠে পড়... ”।
গাঁইগুঁই করতে করতে আমি বাথরুমে যাই। বেসিনের পাশেই রাখা গরম পানির কেতলি। সকালে ঠান্ডা পানি লাগলে আমার আবার হাঁচি হয়। বাথরুম টাথরুম সেরে খাওয়ার টেবিলে গেলেই নাস্তা রেডি। ভাবছেন আমি স্কুলে যাচ্ছি? উহুঁ হলো না, আমি রীতিমত দামড়া ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সকালে যুদ্ধ করে আমাকে উঠাচ্ছেন আমার বাবা। আমাকে ঠেলেঠুলে নানান কৌশলে তড়িৎকৌশলী বানানোটা অনেকটাই তাঁরই অবদান। অধীর আগ্রহ নিয়ে আমাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাচ্ছেন যদিও আমার কোন তাড়া নেই প্রকৌশলী হওয়ার জন্য, ক্লাসে গিয়ে গেট আটকানো দেখলে ক্যাফেতে বসে নরক গুলজার করি, যত ব্যগ্রতা শুধু আব্বার।
আমি তাঁর সর্বশেষ সন্তান, ততদিনে উনি রিটায়ার করেছেন, নানান কাজে ব্যস্ত রাখেন নিজেকে, এর মধ্যে আমাকে ঠেলাঠেলি অন্যতম। সকালে বাজার করেন নিষ্ঠার সাথে, দরাদরি (উনি বলেন মুলামুলি) ছাড়া মানে জিনিস কেনা মানেই তো ঠকা। বাসায় ফিরে দিনে অন্তত একবার সাদা ছোট আলমারিটা খোলা হয়। বেশ কড়া সিকিউরিটি সেটার। ভেতরে কি আছে? টাকা-পয়সা নয়, দুনিয়ার তাবৎ অকাজের জিনিষ। আমাদের পাশের বাড়ির আপা আমাদের বাসা নিয়ে একটা রচনা লিখেছিল, সেটা ভাঁজ করা আছে সযতনে। আছে কিছু ডায়েরী যেখানে বাবা ধরে রেখেছেন আমাদের শৈশবসহ আরও অনেক অ-দরকারি গল্প। একটা ওয়াটার গান পাবেন, আমিই আমেরিকা থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম, এই ভয়াবহ স্টার ওয়ার্সমার্কা অস্ত্র দিয়ে উনি গাছে পানি দিয়েছেন, তাও মনে হয় বেশি দিন নয়। এই স্মৃতির শহরের কয়েকটা পার্টও হয়ত খুঁজে পাবেন সেখানে, অফসেটে প্রিন্ট করা হার্ড কপি। কয়েকটা পুরানো টাকার ফাঁকে ফাঁকে আরো কিছু অতি পুরানো জিনিস খুঁজে পাবেন যেখান থেকে শুধু স্মৃতির গন্ধই ভেসে আসে। আচ্ছা স্মৃতির গন্ধ কি ন্যাপথালিনের মত?
আব্বার উপদেশগুলোও আলমারির জিনিসগুলোর মতই অকাজের। মাথা ধরা, জ্বর, সর্দি, কাশি, দাদ, হেপাটাইটিস, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজিজ যাই হোক না কেন, উনার উপদেশটা কি শুনবেন? “প্রচুর পানি খাইবা”। নিজেও ওই জিনিস বিস্তর “খাচ্ছেন”, অন্যকেও “খেতে” অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। আরও জটিল কোন রোগ যেমন ডিপ্রেশেন অথবা পিত্তথলির প্রদাহে আক্রান্ত হলে আরেকটা দুটো এক্সট্রা উপদেশ পাবেন, “একটু রেস্ট আর লাইট এক্সারসাইজের দরকার”। অসুখ নিয়ে উনার সামনে গেলে আপনিও এইসব প্রেসক্রিপশন পাবেন নিশ্চিত। তবে সমস্যা কি জানেন, ইদানীং আমারো একই অবস্থা, আমার কাছে আসলে আমিও একই উপদেশ দিতে পারি। ভাগ্যিস আমি ডাক্তার নই!!! জীবন নিয়েও উনার উপদেশ বেশ সাদামাটা, “কারোটা খাইবা না”, বেশ ভালো একটা উপদেশ নিঃসন্দেহে। পিতার থেকে পাওয়া এই অল্প কয়েকটা উপদেশ কাঁধে নিয়ে বেশ চালিয়ে যাচ্ছি, অর্ধেক জীবন শেষে নিজে আরো গোটা দুয়েক যোগ করেছি এর সাথে। দেখা হলে সব একসাথে দিয়ে দেবো, মোটামুটি পাঁচ মিনিটের ব্যাপারই তো।
বসার ঘরে আব্বা যেই চেয়ারটায় বসে আছেন, ওটার বয়স আব্বার চেয়ে বছর ত্রিশেক কম হবে। আমার উচিত ঈদের দিন সকালে চেয়ারটাকেও সালাম করা। আব্বা এই সকালে উঠে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়ছেন সেখানে বসে আর মাঝে মাঝে স্বগতোক্তি করছেন...”চোরেরা”...এইটা কাদের বলা বুঝলেন তো? চোরদেরকে বলা, যেই চোরগুলো চুরি করছে আমাদের অতীত থেকে শুরু করে ভবিষৎ পর্যন্ত সবকিছু। আব্বার জামার বোতামগুলোর দিকে আপনার নজর পড়েছে বোধহয়? বাদ দেন ভাই, অনন্তকাল ধরে উনি উল্টোপাল্টা লাগাচ্ছেন ওগুলো, মনে হয় এরকমই চলবে।
ডেন্টিস্টদের কাছে যেতে আমার ব্যাপক ভয়, সেই শৈশব থেকে শুরু করে আজ অব্দি। বুঝলেন ধাড়ি হওয়ার পরেও আব্বা সাথে নিয়ে গেছেন ডেন্টিস্টদের কাছে, তীক্ষ্ণ নজর রেখেছেন ব্যাটাদের উপর। আজকে এই আমাকে একা পেয়ে ওরা ইচ্ছেমত বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে আমার দাঁতের, আর কিছু হলেই লম্বা লম্বা বিল...চোরেরা।
আব্বার শখটা কি শুনবেন? ম্যাজিক, উনি আসলেই একজন ম্যাজিশিয়ান। জুয়েল আইচের মত না হলেও কম নয়। আপনি দড়ি কাটা আর তাসের ম্যাজিক দেখতে পাবেন আমাদের সেই বাসভবনে। খালি খাতা হঠাৎ আঁকিবুঁকিময় হয়ে যাবে উনার যাদুর লাঠিতে। তবে আপনার বয়েস যদি দশের আশেপাশে হয় তবে উপভোগ করবেন সবচেয়ে বেশি। তবে উনার আসল যাদু মনে হয় বাগান কর্মে, যে কোন পতিত জমি উনি কি মায়ামন্ত্র বলে সবুজ করে দেন, এই বিদ্যা আমার এখনও অজানা। আমি গাছ লাগালেই যেন ওঁত পেতে থাকে হাজার সমস্যা, নিজেকে মনে হয় বৃক্ষহন্তারক!
এখন এখানে সকালে বিকট স্বরে ডাক দেয় একটা এ্যালার্ম ঘড়ি, নাছোড়বান্দা হলেও একদম স্নেহ নেই তার গলায়। সকালে বাথরুম থেকে বের হয়ে নিজেই বানিয়ে নেই চা আর কিছু অখাদ্য। তারপর দেশের টিভির নিউজ দেখতে দেখতে মনে হয় আমার ছিয়াশি বছরে যুবক বাবাও হয়ত দেখছেন একই পচনশীলতার খবর, উনার সেই বিরক্তি আজ আমিও ধারন করি। মোটা ফ্রেমের চশমা, সাধারণ একটা জামা আর লুঙ্গী পরণে, বসে আছেন প্রাগৈতিহাসিক চেয়ারে। আমিও দূরে নেই, এইতো একদম প্রায় পাশেই। ভৌগলিক দূরত্ব ভেদ করে সেই বনস্পতির ছায়ারা যেন পৌঁছে যায় এই শহরে। নীরব ও নির্জন এই সকালে ভালোই কেটে যায় সময়টা। স্মৃতির শহর কিন্তু মন্দ নয়, কি বলেন?
No comments:
Post a Comment