স্মৃতির শহর কিন্তু থাকার জন্য দারুন। ওখানে না-গরম, না-ঠান্ডা, লোকজনের ব্যবহার মধুর, রিকশা ভাড়াও বেশ কম। কলে পানি পাওয়া যায় ঠিকমতই, ধূলাবালির প্রকোপ তেমন নেই, মশার উপদ্রব সহনীয়, অসুখ বিসুখের বালাই নেই, কাজকর্ম করলেও চলে, না করলেও অসুবিধা নেই। লোডশেডিং শুধু পূর্ণিমা রাতেই হয়, সাথে একটু উতল হাওয়াও থাকে। বিনা টিকেট, বিনা পাসপোর্টে সেখানে ঢোকা যায়, যতদিন খুশি থাকুন সেখানে কেউ কিছু বলবে না। আমি প্রায়ই যাই সেখানে, আমার ভূমিকা শুধু চোখ মেলে দেখা। আব্বাই সব কিছু সামলান, আমিতো বালক মাত্র। সকালে উঠে উনি আমাকে আইনস্টাইন আর সত্যেন বোসের গল্প শোনান। আমাকে মসজিদে নেওয়ার কথা উনার মনেই নেই। কোন কোন দিন ভোরে রেডিওতে ভাসে আব্দুল আলীমের উথাল পাথাল সুর। আজম খানও যুদ্ধফেরতা যুবক, গান তাঁর ক্রোধ আর অভিমান। রবীন্দ্রনাথ থাকেন ভিনাইল রেকর্ডে, আর ভাইয়ার দরাজ গলার কবিতায়। বৃষ্টির রাতে মাঝে মাঝে সন্ন্যাসী উপগুপ্ত মথুরাপুরী ছেড়ে ভিজতে ভিজতে তেঁজগায়ে চলে আসেন। এই শহরে না ফিরে উপায় আছে?
২৯ নম্বর বাড়িটা আজো টিকে আছে। স্মৃতিতে ও বাস্তবে দুটোতেই। সময় ভায়া অত্যাচার কম করেনি, তারপরও সে পঁয়তাল্লিশ বছর টিকে গেল। একটু ঢুঁ মেরে দেখা যাক স্মৃতিময় বাসবভনে। একজন যুবককে দেখছেন, একটু রাগী রাগী ? আমার বড়ভাই উনি। ঢাকা কলেজের রাগী তরুণ, লম্বা লম্বা চুল, স্বপ্নালু চোখ, পরণে বেলবটম। বুঝলেন চুল কাটার কথা বলে বলে আব্বা হয়রান। বলেও বেশি লাভ নেই, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষেরও (আলাউদ্দিন আল আজাদ?) লম্বা লম্বা চুল। পড়াশুনায় বেশি মন নেই, মন পড়ে আছে আড্ডা, নানান বইপত্র আর মাসুদ রানায়। ঘরে সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ। কয়েকদিন পরে সামরিক আইন জারি হলে নাপিতের দোকান থেকে দ্রুত চুল কাটিয়ে তিনি বাধ্য ছেলে হয়ে গেলেন, না হয়ে উপায় আছে, আর্মি যে রাস্তা থেকে লম্বা চুলের ছেলেদের ধরে চুল কেটে দিচ্ছে, ঢাকা কলেজের অমন দুর্দান্ত প্রিস্নিপাল স্যার, উনিও চুল টুল কেটে ফিটফাট। সামরিক আইন না এলে আমরা কিভাবে এত ডিসিপ্লিন শিখতাম ?
দোতালায় গেলে আমাদের ঘরের পড়ার টেবিলে আমার মেঝ ভাইকে দেখবেন। সুর্দশন এবং ফিটফাট, পড়াশুনাতে দারুন মেধাবী। ভেতরে ভেতরে হয়ত একজন বিজ্ঞানীও বাস করে তাঁর মধ্যে। আমাদের বাসায় অনেকদিন কোন অতিরিক্ত ঘড়ি ছিল না, আব্বা আর আম্মা অফিসে চলে গেলে স্কুলের টাইম হয়েছে কিনা বোঝার জন্য উনি চিলেকোঠার চালের ফুটো দিয়ে আসা সূর্যের রেখা দিয়ে এক ঘড়ি বানিয়ে ছিলেন, সিঁড়ির ঘরের দেওয়ালে সময় লেখা ছিল, সূর্যের রেখা “১০:০০” লেখাকে স্পর্শ করলেই বুঝতাম দশটা বেজে গেছে। বহু বহু বছর পরে বিদেশ থেকে ঘরে ফিরে সেই সিঁড়ির ঘরের এক চিলতে রোদ দেখে হঠাৎ যেন নিমেষেই ধরে ফেলি শৈশবকে।
ওই যে পেটা শরীরের একজন মাঝবয়েসী লোককে দেখছেন, বাসার বাইরের সবুজ জায়গাটায়। বাগানের কাজ করছেন আর গুনগুন করে গাইছেন “আমি বনফুল গো”, উনিই আমার বাবা, এই একটা গানই উনি জানেন। আমি উনার ৪৬তম জন্মদিনে জন্ম নেওয়া শেষ সন্তান। আমাদের সংসারে উনারা ভূমিকা ব্যাপক কিন্তু নিরব। অনেকটা অপরেটিং সিস্টেমের মতই সর্বত্রই উনার নিঃশব্দ উপস্থিতি । আমাদের সবারই সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করেন, এই সংসারের উনি স্বরাষ্ট্র, আর পূর্তসহ আরও অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। উনার শরীর সর্বদাই সুঠাম, খুব কমই অসুস্থ হয়েছেন তিনি। যৌবনে খেলাধূলা আর প্রচুর কায়িক শ্রমের সুফল আজো ভোগ করে চলেছেন। আমাদের আরাম আয়েশ নিশ্চিত করে রাতে ঘুমাতে যান আর সবার আগে উঠে নানান কাজ শুরু করে দেন। বাসার সামনে অমন সুন্দর বাগানটাও উনার তৈরি, এছাড়াও নানান ফলের গাছ লাগিয়ে উনি বাসাটাকে রীতিমত নন্দনকানন বানিয়ে ফেলেছেন।
আমার আম্মাকে চিনেছেন ? গম্ভীর মহিলা, আমেরিকার জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেও থাকার চেষ্টা করেননি সেদেশে, আর আমি তাঁর কুপুত্র এদের মাটি কামড়ে পড়ে আছি। আম্মা দারুন সব গল্প বলতে পারেন, কাজের শেষে মুখে মুখে আমাদের অসাধারণ গল্প শোনান। আমি অনেক বছর তাঁর গল্প শুনেছি, ১০/১২ বয়েসেও উনি আমাকে মোটামুটি মুগ্ধ করে রাখতেন। আমি তাঁর গল্প শুনে বিশ্বাস করেছিলাম যে উনি আসলে পরীদের দেশ থেকে এসেছেন, হঠাৎ একদিন সেখানে চলেও যেতে পারেন। আমাদের পরিবারের বাজেট আম্মার হাতে, বলতেই হবে সেই বাজেটে অপচয় বলে শব্দ নেই। চেয়ার, টেবিল, বিছানা সবই নড়বড়ে। কয়েকদিন পরেতো মরেই যাব, কি হবে দামী জিনিস কিনে? এই নশ্বরতার চিন্তায় কোন কিছুই কিনে উঠা হয়নি। বাসার অনেক পর্দাই আম্মার পুরানো শাড়ি দিয়ে বানানো, কোথাও কোন বাহুল্য নেই। বিয়ের (১৯৫২) পরে কেনা দুটো চেয়ার এখনও আছে বাসায়। অনেক বছর পরে স্যাটায়ার ম্যাগাজিন অনিয়নে একটা নিউজ দেখে অট্টহাসি হাসতে হাসতে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
আম্মা আমাদের শাসন বেশি করেন না, মাঝে সাঝে বকা দেন, আর বছরে শুধু একদিন ধরে আচ্ছা করেন ধোলাই দেন। সমস্য হল বছরে কোন দিন ধোলাইটা দেওয়া হবে সেটা আগে থেকে বলা থাকে না। অনেক দুষ্টামি করে আজ পার পেয়ে গেলেও সামান্য কারনে তিনমাস পরে ধরা খাওয়ার চান্স আছে। মারের আনসার্টেনিটির ভয়ে সারা বছরই আমরা সিধে হয়ে থাকতাম।
আমাকে খুঁজে পাচ্ছেন না? ছাদে আছি মনে হয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান সোজা দোতালার ছাদে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিতে পারেন সত্তর দশকের তেঁজগা, পুরো রাস্তায় পাঁচটা মাত্র বাড়ি, পূর্ব দিকে একটু দূরেই ট্রেনের লাইন, আরেকটু দূরে তাকালে দেখবেন পুরানো কিছু কল কারখানা, দিনটা যদি ভেজা ভেজা থাকে তাহলে নাবিস্কো কারখানার বিস্কুটের গন্ধও পাবেন, টাটকা এবং মনকাড়া। পশ্চিমে বিজ্ঞান কলেজের মাঠ, খ্রীষ্টানদের চার্চ আর কবরস্থান, হলিক্রস কলেজ। একটু দূরের তেঁজগা বিমানবন্দরের প্লেনগুলো মনে হয় হলিক্রস কলেজের উপর দিয়েই যাওয়া আসা করে। ছাদের পশ্চিম দিকে একটা পানির ট্যাঙ্ক দেখবেন, আমি সম্ভবত ট্যাঙ্কের নীচেই আছি, মাদুর বিছানো আছে মনে হয়। এইখানে বসেই চলে আমার বিশ্বভ্রমণ, শিব্রাম থেকে মাসুদ রানা অনেক কিছুই পড়েছি এইখানে। শৈশবে ফিরব অথচ ছাদে যাব না, তাও কি হয়? যদি ঝমঝম বৃষ্টি হয় তবে, দক্ষিণে তাকাতে ভুলবেন না, বিজ্ঞান কলেজের পুকুরে ব্যাংগদের কনসার্ট চলছে, আরেকটু দূরে তাকালেই দেখবেন পুকুরের পারের রাস্তাটা যেন মিশে গেছে বর্ষায়। এই ধুম বৃষ্টিতে আপনি ভিজছেন অথচ ঠান্ডা লাগার ভয় নেই, টনসিল ব্যথা করবে না, কি আশ্চর্য স্মৃতির শহর।
সিগারেট থেকে ভালোবাসা, আড্ডা থেকে বিচ্ছেদ, বিদেশ যাত্রা থেকে বিয়ে, গায়ে হলুদ থেকে জন্মদিন, আর যা যা আছে জীবনের অনুষঙ্গ, সবই জানে এই ২৯ নম্বর, উজবুকের মত দাঁড়িয়ে থাকলে আসলে সে সবজান্তা এক মিউজিয়াম। সময়ের নিষ্ঠুর হাত পড়েছে সব্বার উপর। বাড়িটাও মলিন হয়ে গেছে। চাইলেও ভাইয়া আর চুল বড় করতে পারবেন না। তিনি বাস করেন আরেক দূরদেশে, নিকোটিনকে নির্বাসনে দিয়েছেন বহু বছর হল। যে যুবককে দেখলেন আজ, তাঁর সন্তানও সেই বয়েসে পৌঁছে গেছে প্রায়। মেজভাইও ব্যস্ত ক্লাস আর নানান প্রজেক্ট আর সেমিনারে, শৈশব মনে হয় অতিদূর সমুদ্রের পারে, ধারে কাছে কোথাও নেই। আম্মা কর্কটরোগ সহ আরো নানা ব্যধিকে পরাভূত করে ক্লান্ত। আব্বা যেন নিজেই ইতিহাস এক, মাঝে মাঝে উনি অতীত আর বর্তমান ভুলে যান। আব্দুল আলীমকে কেউ মনে রাখেনি, সন্ন্যাসী উপগুপ্ত এদিকে আর আসেন না তেমন, আজম খানও বুড়ো হয়ে গেছেন আর আমাকে রেখে গেছেন মাঝ বয়েসের কাছাকাছি কোন নির্জন জায়গায়। তবুও কিন্তু বালকবেলায় ফিরতে পারি এক লহমায়, যেকোন সকালে চায়ের কাপে, নিঃসংগে বা সংসর্গে...
সজীব সকালে চোখ মেলি, প্রতিদিনের পৃথিবী
আমাকে জানায় অভিবাদন। টাটকা রোদ,
পাখিদের ওড়াওড়ি, গাছের পাতার দুলুনি, বেলফুলের গন্ধ
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে।
(একটি দুপুরের উপকথা/শামসুর রাহমান)
No comments:
Post a Comment