প্রধান সড়কে আর প্রতিটি গলির মোড়ে মোড়ে
কাঁটামারা জুতো ঘোরে। এরই মধ্যে হতচ্ছাড়া মন
তোমার সংকেত পায়, হদয়ের সাহসের তোড়ে
আমরা দু'জন ভেসে চলি রূঢ় পথে স্বপ্ন বেয়ে।
(পুলিশও প্রত্যক্ষ করে)
কবি সারাজীবন কাটিয়েছেন এই শহরে এবং সেই জীবনের প্রায় পুরোটাই দিয়েছেন কবিতার পিছনে। পুরানো ঢাকা শহরের অলিগলি উঁকি দিয়েছে কবিতায়, যত্রতত্র হানা দিয়েছে শৈশবের হলুদ রঙের বিকেল। নোংরা আর ময়লা মুছে ফেলে এই শহর যেন বিশুদ্ধ হয়েছে তাঁর কবিতায়। জয়দেবপুরের দিকে গেলে চৌরাস্তার মোড়ে আমি দেখি পোস্টারে ছাওয়া গোল চক্করে ঝালমুড়ি বিক্রেতার হাঁকডাক আর তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে এক পাথুরে মুক্তিযোদ্ধা রাইফেল হাতে অবিচল, আর উনি দেখছেন...
কখনো কখনো মনে হয় তোমার পাথুরে বুক
ঘন ঘন স্পন্দিত নিশ্বাসে। হে অজ্ঞাত বীর, শোনো,
তোমার সংগ্রামী স্মৃতি মাছের কাঁটার মত লেগে
আছে আমাদের বিবেকের শীর্ণ গলায় নিয়ত।
(জয়দেবপুরের মুক্তিযোদ্ধা)
বিবেক মনে হয় আমাদের একটু শীর্ণই বটে, স্বৈরাচার কিনে নিয়েছিল বুদ্ধিজীবী থেকে ছাত্রনেতা, কবি থেকে টিভি উপস্থাপক। সেই একই বাণিজ্য আজো চলছে অবাধে, কাউকে কিনছে দুই ফ্লেভারের জাতীয়তাবাদ, কেউ নিজেকে বেচছে মৌলবাদের কাছে, ইতিহাস কিনছে ফোন কোম্পানী, কেউবা নতজানু খতিবের সামনে। শিক্ষকরাও নানান রঙে নিজেদের সাজিয়ে উপস্থিত এই মুক্তবাজারে। কবি কিভাবে এতকিছু দেখে ফেলেন?
শুনেছি স্বৈরাচারের প্রতিবাদে সরকারী চাকরী ছেড়ে দিয়েছিলেন উনি। কবিতা ছাড়া অন্য কিছুতে বেশিতে মন দেন নি, ফলে নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছে অনেকবার, তবু পণ্য হয়নি তাঁর প্রতিভা। তাই যখন নূর হোসেন গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে জিরো পয়েন্টে, আমার অসীম ক্রোধ আর অসহায়তা যেন তাঁরই কলমের নিবে...
শহরের টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়ে; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।
(বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়)
বেঁচে থাকলে কেমন লাগত আজ তাঁর ক্ষমতার সমীকরণে স্বৈরাচারকে মসনদের কাছাকাছি দেখে?
তাঁর কবিতায় দেশচিন্তা এসেছে বহু বার। উদ্ভট যে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম উলটো পথে, সেই যাত্রা মনে হয় শুধুই বেগবান হয়েছে। আমি বিষাদে ও বিবমিষায় উগরে দিয়েছি খিস্তি, আর তিনি চেয়েছেন দেশদ্রোহী হতে...
হে-পাক পারওয়ার দিগার, হে বিশ্বপালক,
আপনি আমাকে লহমায়
একজন তুখোড় রাজাকার করে দিন। তাহলেই আমি
দ্বীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায়
তেল ঢালতে পারবো অবিরল,
গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর
মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে
ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগবিদিক আর সবার নাকের তলায়
একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মত অহর্নিশ
কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো, অব-কাঠামো।
(একটি মোনাজাতের খসড়া)
তাইতো মনে হয় সাদামাটা আর নির্বিরোধী জীবন যাপন করেও শিকার হয়েছিলেন মৌলবাদী হামলার, বেঁচেও গেছেন ভাগ্য আর হয়ত মানুষের ভালোবাসার জোরে। পরিণত বয়েসেই তাঁর মৃত্যু হয়। টিভিতে দেখেছি তাঁর শেষ শ্রদ্ধায় হাজার মানুষের ঢল, অনেকেই হয়ত পড়েননি তাঁর কবিতা তবু নাগরিক শহরের খুব কাছের মানুষই তিনি। আমি তার অনেক আগেই ছেড়ে এসেছি স্মৃতির শহর, কবি ও কবিতা দুই থেকেই দূরে। প্রাত্যহিক জীবনের চাপে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম ফেলে আসা জীবনের কথা। তিনি গত হওয়ার পরদিন পরবাস পত্রিকার সমীরদার কাছ থেকে তাঁর একটা বই জোগাড় করি, পরবাসে ছোট একটা লেখাও লেখেছিলাম তাঁকে নিয়ে। আবার বহু বছর পর তাঁর কবিতা ফিরে এল আমার কাছে পুরানো প্রেয়সির মত। আর গতজন্মের স্মৃতির মত ফিরে এল শৈশব, কৈশোর এবং প্রথম যৌবনের গল্পগুলো। কাঠখোট্টা এই বাস্তবের পাশেই আরশি নগরের মত স্মৃতির শহরের খোঁজ পেয়ে গেলাম।
এরপর ঢাকা থেকে এনেছি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন, আনন্দ ও বেদনায় আঁকড়ে রাখি বইটাকে, কখনও চোখের জলে বইয়ের পাতা ভিজে গেলে সপ্তপর্ণে মুছে রেখে দেই শেলফে। মাঝে মাঝে ব্যস্ত দিনের কাজের ফাঁকে বাচ্চুর মত এক অবুঝ বালক এসে আমাকেও বড় জ্বালাতন করে। কাজ ফেলে সেই বালকের সংগে ঢুকে যাই স্মৃতির শহরে, মিথ্যা হয়ে যায় যা যা কিছু পার্থিব আছে এই সংসারে। ক্ষণিকের জন্য ভুলে যাই আমার সময়ও সুমিষ্ট পিঠের মতই ভাগ করে খাচ্ছে সবাই। কবি আপনার সাথেই যেন চলে আমার এই আশ্চর্য ভ্রমণ।
ছেচল্লিশ মাহুৎটুলীর খোলা ছাদে। আমি ব্যস্ত, বড়ো ব্যস্ত,
এখন তোমার সংগে, তোর সংগে বাক্যালাপ করার মতন
একটুও সময় নেই। কেন তুই মিছেমিছি এখানে দাঁড়িয়ে
কষ্ট পাবি বল?
..................
চিনতিস তুই যাকে সে আমার
মধ্য থেকে উঠে
বিষম সুদূর ধু-ধু অন্তরালে চ'লে গেছে। তুইও যা, চ'লে যা।
(দুঃসময়ের মুখোমুখি)
No comments:
Post a Comment