Thursday, November 25, 2010

স্মৃতির শহরঃ হাবিবিয়া লাইব্রেরি

বইয়ের দোকানকে কেন লাইব্রেরি বলে এই প্রশ্নের জবাব আজও পাইনি। এরকম না পাওয়া অনেক প্রশ্নের “এক্স-ফাইল” তৈরি আছে মনে ভেতর। উত্তর পাব এই আশাও রাখি না। আজকের গল্প ফার্মগেটের একটি “লাইব্রেরিকে” নিয়ে। আমাদের তেজগাঁর বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে ফার্মগেট। বড় ব্যস্ত এই জায়গা। বাসগুলো রাস্তা আটকে লোক উঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে। পাশের ফুটপাথে বিক্রেতারা হাজারো পণ্যের পসরা সাজিয়ে হাঁকডাঁক দিচ্ছে, সেদ্ধ ডিম থেকে পরকালে যাবার চাবিকাঠি সবই বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। রিকশা, অটোরিক্সা, টেম্পো কেউ কোন নিয়ম মানার ভেতরে নেই, পুলিশ স্যার খুশি থাকলেই হল। বারো আনা পয়সা থেকে আধ খাওয়া বিড়ি, সবই গ্রহণযোগ্য পুলিশের কাছে, উনাদেরকে সর্বভুক না বলে আগুনকে কেন সর্বভুক বলা হয় সেই প্রশ্নেরও সুরাহা হয় নি। একটু দূরেই “আনন্দ” সিনেমা হল , একটু ভালো করে তাকালে সেখানে রাজ্জাক আর কবরীর স্বর্ণযুগ দেখা যাবে সুনিশ্চিত। পাশের ওভারব্রিজটাতে অনেক মানুষ উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করছে, আমাকেও হয়ত পাবেন ওদের ভিড়ে। একটা ছোট পার্কও আছে, এই দুপুরবেলাতে সেখানে ঝিমাচ্ছে কিছু মেয়ে যাদের অফিস খুলবে সন্ধ্যা হলেই। আরো আছে বায়ু দূষণ, বিকটদর্শন সব ভিখিরি আর সর্বরোগের ঔষধ বিক্রেতারা। আমার জীবনে দেখা প্রথম “মুক্তবাজার” হচ্ছে এই ফার্মগেট ।

হাবিবিয়া লাইব্রেরি ছিল ফার্মগেটের মোড়েই। আমি এখন এটাকে হয়ত একটা নিউজস্ট্যান্ডই বলব। দোকানে ঢোকার উপায় কোন নেই, ক্রেতারা সব বাইরে দাঁড়িয়ে। ক্রেতার চেয়ে পাঠকই বেশি, কেউ পাঠ করেছেন দৈনিক পত্রিকা, কারো মনোযোগ সাপ্তাহিকে, কেউ গিলছেন প্রগতি বা সেবা প্রকাশনার বই, কেউ ধর্মীয় বই পড়ে হাফেজ হচ্ছেন অথবা কেউবা ঝোলাঝুলি করছেন রসময় গুপ্তের বইগুলো একটু পাওয়ার জন্য। ফার্মগেট এলাকার বহুমুখি চরিত্রটা অনেকখানিই ধারণ করে এই হাবিবিয়া লাইব্রেরি। আমি এগারো বছরের বালক এসেছি দেখতে আনন্দমেলা পত্রিকাটা এসেছে কিনা। আনন্দবাজার পাবলিশার্সের এই কিশোর পত্রিকাটা পাক্ষিক বের হয় কলকাতা থেকে, ঢাকায় আসতে প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে যায়। টাকা আর রুপির বিনিময় রেটকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দুই টাকা দামের এই পত্রিকার দাম বাংলাদেশে রাখা হয় ছয় টাকা। তাও সই, পাতা উল্টালেই যে আছে আনন্দের সম্ভার, বলতে হবে ছয়টাকা কমই দাম। মলাটের ভেতর আছেন কাকাবাবু, সন্তু, কেইন শিপটন, ক্যাপ্টেন হ্যাডক, গবা পাগলা, অম্বর সেন, উইং থেকে গোল, শব্দকল্পদ্রুম, রোভার্সের রয়, গাবলু, ক্লাস টেনের ফার্স্ট বয়, হারানো কাকাতুয়া, বসু বাড়ি আর শৈশবের ভুলে যাওয়া সব গল্প আর ছবি।

“আজকেও আসে নাই ভাইয়া, কালকে আসতে পারে, কি একটা ধর্মঘট চলতাসে” বিক্রেতার সস্নেহ জবাব।

আমি আবার যাই পরদিন। পত্রিকাটা হাতে পেলে সুট করে ঢুকে যাই পাশের রেঁস্তোরা “হোটেল সাইনু পালোয়ানে”। ওখানের লাস্যি আমার খুবই পছন্দের, দই আর বরফের ভালোবাসার এই পরিমিতবোধ আর কেউই দেখাতে পারেনি। লাস্যি সাবাড় করতে করতে দ্রুত পাতা উল্টাই, বাসায় গেলেই আনন্দমেলাতে ভাগ বসাবে অনেকেই, শুনেছি আনন্দ নাকি ভাগ করলে বেড়ে যায়, তবুও কেন আমার এই স্বার্থপরতা !!!

আমি বড় হতে থাকি, হাবিবিয়াতে গেলে আমিও আনমনে নাড়াচাড়া করি গুপ্তবাবুর বইগুলো। দোকানি দেখে ও না দেখার ভান করে, ক্রেতা হচ্ছে লক্ষী, তাকে নীতিকথা বলে পায়ে ঠেলার কোন মানে হয়? তাছাড়া আগের বুড়ো দোকানির সাথে এক ছোকরা বসে এখন। হিসেব করে দেখলে আমার চেয়ে অল্পই বড় সে। ক্রেতাদের চরিত্রে কোন পরিবর্তন নেই, আমি না খুঁজলেও কেউ না কেউ কিনছে আনন্দমেলা। ছোকরা দোকানিই সব সামলায়, গ্যাংগ্রিনে কাটা পড়েছে বুড়োর একটা পা, পেটের ক্ষিধে তাও কমে না তাই হয়ত রিটায়ারমেন্টে যাওয়া আর হয়ে উঠে নি। বিষন্ন বুড়োটা সারাদিন ঝিমায়, একটু খিটখিটে হয়ে গেছে তার মেজাজ, একটু তরিবত করে কেউ কিছু দীর্ঘক্ষন ধরে পড়লেই সে তেতে উঠে।

ফার্মগেট আমার শৈশবের প্রিয় ভ্যাকেশন স্পট, কারণ অকারণে প্রায়ই যেতাম সেখানে। একদিন সকালে হাঁটতে গিয়ে দেখি বিশাল জমায়েত। রাজউকের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ চলছে। এই প্রথমবারের মত জানলাম হাবিবিয়া লাইব্রেরি আর হোটেল সাইনু পালোয়ান দুটোই অবৈধ। একটু দূরে নতুন তৈরি হওয়া একটা আধুনিক বার্গারের দোকান, সেটাও নাকি অবৈধ। হাজার হাজার উৎসুক জনতার সামনে ভাঙ্গা হল সবগুলো স্থাপনা। চোখের সামনেই ধ্বংস হোল হাবিবিয়া লাইব্রেরি, বুড়োর হাউমাউ কান্নাতেও কারো মন গলল না, দ্রুত কার্যকর হল হাবিবিয়া লাইব্রেরির মৃত্যুদন্ড। এরশাদের আমল তখন, উনার কথাই আইন, উনি চাইছেন ফার্মগেট আরো সুন্দর হোক। তাছাড়া সাধারণ মানুষের হাহাকারগুলোও বেশিদূর যেতে পারে না।

এর কয়েকদিন পরে দেখলাম ছোকরা দোকানিকে। আগের দোকানের কাছেই এবার ফুটপাথে পাটি বিছিয়ে বেচছে দৈনিক পত্রিকা আর ম্যাগাজিন। এবারের দোকানের অবৈধতা নিয়ে কোন সংশয় নেই। বুড়োকে দেখলাম না আর ধারে কাছে। ছোকরা জানাল বুড়ো অসুস্থ। ওই পথ দিয়ে আসা যাওয়া ছিল, প্রায়ই কথা হত ছোকরার সাথে। একদিন শুনলাম বুড়ো মারা গেছে। আমার বইয়ের আগ্রহ তখন নানামুখি, হাবিবিয়া আর পূরণ করতে পারে না সেই চাহিদা তাও মাঝে মাঝে কথা হয় দোকানির সাথে। বিদেশে আসার আগেও বিদায় নিয়েছি সেই দোকানির কাছ থেকে।

কয়েক বছর আগে দেখলাম কলকাতা থেকে বইপত্র আনার সার্ভিস চালু হয়েছে। আমি একবছরের জন্য গ্রাহক হয়ে গেলাম আনন্দমেলা পত্রিকার। আমার বয়স তখন ছত্রিশ আমার কন্যারা দুইয়ের নীচে। ঠিক কে হবে এই পত্রিকার পাঠক সেটা আমিই নিজে বুঝলাম না। কলকাতা থেকে রাজিব চক্রবর্তী প্রথম সংখ্যাটা পাঠিয়ে আমাকে ই-মেইল করে দিলেন, জানালেন সাত থেকে দশদিনের মধ্যেই পেয়ে যাব আমি। এই এক কথায় আমি ক্লাসে ফাইভে ফিরে গেলাম, প্রতিদিন চিঠির বাক্স হাতড়াই সেই বালকবেলার আগ্রহ নিয়ে। মাঝে মাঝে ফিরে আসে হাবিবিয়া লাইব্রেরি, ছিমছাম এই পাড়ার নৈঃশব্দ ঠেলেঠুলে ফার্মগেটও এসে দাঁড়ায় তার কলরবময় আপন সৌন্দর্য নিয়ে। সেই প্রথম পাঠ, কোলাহলমুখর নগরী, পুলিশের দুর্নীতি, রাজ্জাক, কবরী, ফুটপাথের বিক্রেতা, ভিখিরি আর দুঃখী দুঃখী চেহারার “নষ্ট” মেয়েরা আসতে লাগল দলবেঁধে। তারপর সত্যি একদিন ডাকপিয়ন নানান বিলের সাথে রেখে গেলেন মলাটবন্দি আনন্দ। পড়ন্ত বিকেল বেলার শেষ আলোয় চিঠির বাক্সের চাবি খুলে আমি যেন আবিষ্কার করে নেই একটুকরো স্মৃতির শহর। কি আশ্চর্য এই শহর, সময় যেন ওখানে স্থির হয়ে আছে কি এক মায়ামন্ত্র বলে!! এইজন্যই কি কাজ ফেলে এখানে আসা হয় এত ঘন ঘন?

No comments: