আমাদের ইশকুলে যাবেন? আচ্ছা আচ্ছা বলে দিচ্ছি কিভাবে যেতে হবে। ফার্মগেট থেকে ঢাকা কলেজে যাওয়ার টেম্পো ধরবেন, এটাকে আমরা হেলিকপ্টার বলি। উঠলেই বুঝবেন নামকরণ কতখানি সার্থক। ভট ভট শব্দে কানের পোকা আর ঝাঁকানিতে বাতের ব্যথার অনেকখানি উপশম হতে পারে। যাওয়ার পথটা কিন্তু দারুন, একদম "সিনিক"। হেলিকপ্টার আপনাকে গ্রীন রোড ধরে সোজা কাঁঠাল বাগান পার করে উড়িয়ে নিয়ে যাবে গ্রীন কর্নারের সামনে দিয়ে, পাশে ধানমন্ডি সাত নম্বর রোডের দীঘির মত বড় পুকুর একটা। একটা জমজমাট রেঁস্তোরা পড়বে পথে, নাম ভুলে গেছি, ইচ্ছে ছিল বড় হয়েই কাবাব খাব ওই দোকানের, কিন্তু আমি বড় হতেই ওটার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। সাইন্স ল্যাব পার হয়ে যখন আপনি ঢাকা কলেজের সামনে নেমেছেন, মাত্র দশ মিনিট পার হয়েছে! বিশ্বাস হচ্ছে না ? না হওয়ারই কি কথা, এখন বিএমডাব্লিউ হাঁকিয়েও আপনি এই পথ দশ মিনিটে পার হতে পারবেন না। স্মৃতির শহরে মনে হয় প্রতিদিনই হরতাল চলে!
ঢাকা কলেজের সামনে নেমে মরণচাঁদের মিষ্টির দোকানে একটু খাবেন নাকি? ইশকুল শুরু হতে বাকি আছে আরো কিছু সময়। ঠিক সাড়ে দশটায় মালুম ভাই ঘন্টা পিটাবেন। মালুম ভাই হচ্ছেন আমাদের স্থায়ী ঘন্টাবাদক, বয়স মনে হয় একশ-টেকশ হবে। পাকিস্তানি সেনারা বন্দুক দিয়ে পিটিয়ে সামনের দাঁতগুলো ভেঙ্গে দিয়েছে, কিন্ত তাও হাসিটা কি অমলিন! আমার নাম বললে চোখ ছলছল করে পুরানো গল্প বলা শুরু করবে, গায়ে হাত বুলিয়ে আদরও করতে পারে। স্মৃতির শহরে দয়া, মায়া আর ভালোবাসা সব এখনো অটুট আছে, ওখানে আমরা কাউকেই ভুলিনি অথবা কেউ কাউকে ছেড়ে যাইনি।
দেরি হয়ে যাচ্ছে না? আমার তাড়া নেই যদিও। যাহোক ইশকুলে ঢুকতে হবে কিন্তু মূল দরজা দিয়ে নয় বরং ব্যাকডোর দিয়ে। কেন? আমরা তাই করি যে। আপনি করবেন কি, ঢাকা কলেজের পাশের টিচার্স ট্র্বেইনিং কলেজের গেট দিয়ে ঢুকবেন। ঢুকেই মনে হবে ইন্দ্রপুরী! কি সুন্দর একটা বাগান। দুই দিকে উঁচু উঁচু গাছ আর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সরু রাস্তা বড় একটা মাঠের পাশ দিয়ে, এইটা গাড়িওয়ালা লোকের জন্য না বরং আম জনতার পায়ে চলার রাস্তা। আপনি হাঁটতে থাকুন রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে। আমি দশ বছর হেঁটেছি এই পথে, এখনও মাঝে মাঝে একটু আধটু যাই ওই দিকে। পথের শেষ মাথায় কিন্তু কয়েকজন ভি আই পি এর দেখা পাবেন। এঁরা হচ্ছে, যথাক্রমে চটপটি মামু, আমড়া মামু, আচার মামু আর আইসক্রিম মামু। এদের নামই বলে দেয় উনাদের কি পেশা। আমার নাম বললে বাকিতে খেতে পারবেন সব জায়গায়, শুধু আইসক্রিম মামু কোন বাকির ব্যবসা করেন না। আমড়া মামু নিজেও দুপুরে আমড়া খান, সেই সি-ভিটামিনের জোরেই হয়ত দশ বছর আগেও আমার চেয়ে জোয়ান ছিলেন। চটপটি মামুও মাটির মানুষ, টক দিতে কোন কার্পণ্য নেই তার। আচার মামু প্রায় ম্যাজিশিয়ান, কবিরাজি ওধুধের মত একটা পুরিয়া মিকচার করে দেবে, একদম যেন অমৃত।
যাক উনাদের বিজনেস স্পটটা পার হতেই দেখবেন তাঁর কাটার দেয়ালে এক চিলতে একটা ফাঁক, একটু ঢাল, নামতেই ব্যাস আমাদের ইশকুল। খান মুহাম্মদ সালেক স্যারের বানানো আর আমাদের ধ্বংস করা। শুনেছেন ছড়াটা, আমাদের স্কুলটা হলুদ, ছাত্রগুলো বলদ, বেঞ্চিগুলো সরু, মাস্টারগুলো গরু? ইশকুলটা আসলেই হলুদ, আর আমরা অল্প কয়েকটা বলদ আছি এইটুকই যা সত্য, বাকি সবই উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা!
আপনি তো ভাই স্কুলে ঢুকে পড়লেন, আপনার পরনে কি আছে? আমাদের ড্রেস কিন্তু সাদা সার্ট আর নীল প্যান্ট। জিন্স না পড়লেই ভালো, স্যাররা খুব ভালো চোখে দেখেন না এই বস্তু। উনারা পুরানো আমলের লোক, জিন্স পড়লে ভাববে আপনি পাট নিচ্ছেন। আচ্ছা বলুন তো কোন মানে হয়, জিন্সের মত সস্তা আর আরামের কাপড় আছে আর? যাহোক হাঁটতে থাকুন সামনে আরেকটু। আমাদের মাঠটা কত বড় দেখেছেন? তবে একটু সাবধানে যাবেন, দূর্ধর্ষ স্যার আছেন কয়েকজন। টাইগার স্যার, হালদার স্যার, রুহুল আমিন স্যার আর মতিউল্লাহ স্যার। যার টাইটেল টাইগার তার সামনে না পড়াই ভালো। হালদার স্যার এমনিতে ভাল মানুষ কিন্তু রেগে গেলেই রুদ্র মূর্তি। মতিউল্লাহ স্যার আপনাকে গত বার্ষিক পরীক্ষায় অঙ্কের নাম্বার জিজ্ঞেস করতে পারে, কম নম্বর পেলে বিপদের সমূহ সম্ভবনা। রুহুল আমিন স্যার একটু মুডি, সালাম দিয়ে সরে আসাটাই বরং ভালো। ভয় পাইয়ে দিয়েছি? ভয় নেই ভাই আমরাতো রোজ আসছি আর যাচ্ছি, প্রতিদিন কি আর মার খাই?
ওই যে বালকগুলো কে দেখছেন, ওরাই হচ্ছে আমরা। পরনে সাদা সার্ট আর নীল প্যান্ট, দূর থেকে সব একরকম লাগছে। এমনকি কাছে আসলেও একই রকম লাগতে পারে। আমার তো এখনো একই লাগে। ওইখানে বড়লোকের ছেলেও যেমন আছে আর আমাদের দারোয়ান মোখলেস ভাইয়ের ছেলে ইদ্রিসও আছে। সবাইকে একই হাঁড়িতে সিদ্ধ করেন স্যারেরা। ধনী গরিব কোন ভেদাভেদ নেই তাঁদের কাছে, সবাইকে মেরে তক্তা করে দেন, মনে হয় এইজন্যেই তো আমরা এতো সমাজতন্ত্রী। একই হাঁড়িতে সিদ্ধ না হলে আর কমরেড কিসের? ভাই মাথা নীচু করে বালকগুলোর হাফ প্যান্টের নীচে তাকাবেন না কিন্তু। গার্মেন্টস শিল্প বলে কিছু নেই স্মৃতির শহরে, গ্রামের গরিব মেয়েরা মানুষের বাসাতেই কাজ করে মরে, গার্মেন্টসে নয়। তাই আমাদের জামাগুলো দর্জি বাড়িতে বানানো, দুইটা লাফ দিলেই পটাস, একদম জায়গা মত প্যান্ট ছেঁড়া। আমরা লজ্জিত নই যদিও তবু ক্লাস টেনের দুষ্টু ছেলেগুলো কেন জানি হাসাহাসি করে।
একটু ঘুরে দেখা যেতে পারে চারিদিক । একটু দূরেই মাঠে মোখলেস ভাই জাতীয় পতাকা উঠিয়েছেন, স্কুল শুরুর পরেই আমরা এখানে এসে জাতীয় সংগীত গাইব। আমাদের যাদের গলা দিয়ে হাঁসের মত ফ্যাঁসফ্যাঁসে শব্দ বের হয় তারা শুধু ঠোঁট মেলাব। ভুল সুরে জোরে গাইলে আমাদের জোবেদ আলী স্যার গদাম করে মাথায় চাঁটি বসিয়ে দেবেন কিন্তু! উনি নিজে এ কাজটা করার সময়ও জাতীয় সঙ্গীত গাইতে থাকেন। এসেম্বলী শেষ হলেই ক্লাস শুরু হয়। ছোটদের চার পিরিয়ড আর বড়দের আট পিরিয়ড। মনে হয় এটাই সবচেয়ে বিপদজনক সময়; অংক, বাংলা, ইংরেজি অথবা বিজ্ঞান সব ভুলেরই একটাই শাস্তি, সেটা হল মার। স্কুলের অফিস রুমে নানান সাইজের বেত আছে, কখনো কখনো স্যাররা ক্ষেপে গেলে জবা গাছের ডাল ভেঙ্গেই হামলা চালান, কেউ কেউ আবার মাথার ছয় ইঞ্চি উপর থেকে এমন গাট্টা মারেন যে চোখে অন্ধকার দেখতে হয়। শিক্ষার যে কোন রাজকীয় পথ নেই তা বেশ বুঝেছি আমরা।
স্কুলের বিল্ডিংটা অনেক বড়, অনেকগুলো করিডোর। সবখানেই আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। আমাদের আপনি ক্লাস থ্রীর সামনে জবার বাগানেও পাবেন আবার স্কুলের পেছনের দিকে টিফিন ঘরের কাছেও পাবেন। স্কুলের সামনের দিকে হেড স্যারের রুমের আশে পাশে ঘুরঘুর করা বালকগুলোও আমরা, দোতলায় গেলেও আমরা আছি আবার স্কুলের দেওয়াল টপকে যেই ছেলেগুলো পালাচ্ছে তারা কিন্তু আমরাই। ঝমঝম বৃষ্টি হলে করিডোরগুলোতে পানি প্রায় উঠি উঠি অবস্থা আর আমাদেরও মহানন্দ তাতে; কেন জানি স্মৃতির শহরে প্রায়ই ধুম বৃষ্টি হয় আজকাল। আজকে সময় প্রায় শেষ, আমার বন্ধুদের সাথে আপনার শিগগির'ই পরিচয় করিয়ে দেব, এরাও অনেকে বালকবেলায় ফেরার জন্য আমারই মত ব্যাকুল।
[এই পর্ব আর এর আগের পর্ব প্রায় একই সময়ে লিখেছি, কিন্তু এই পর্ব লিখতে গিয়ে মন বিবশ হয়েছে অনেকবার। স্কুলের অনেক স্যার আর নেই, একজন সহপাঠীও ছেড়ে গেছেন আমাদের। স্মৃতির শহর ছাড়া আর কোথাও তাঁদের পাওয়া যায় না। একদিন আমরা সবাইতো শুধু স্মৃতির শহরেরই বাসিন্দা হব। অনেক স্যার দারিদ্র্যর সাথে শেষ বয়েসে এসে যুদ্ধ করেছেন, আমাদের অনেককেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন কিন্তু প্রতিদানে কিছুই পাননি। আমরা স্বার্থপরের মত ভুলে গেছি যে একটা সাফল্যের পেছনে বহু মানুষের নীরব শ্রম থাকে, আমাদের সাফল্যগুলো আমাদের পুরো একার নয়। তেমনি হয়ত আমাদের ব্যর্থতাগুলোর সব দায়ও হয়ত আমাদের না। সাফল্যের প্রবল আনন্দে অথবা ব্যর্থতার বাঁধভাঙ্গা দুঃখে আমরা যে দুটোই ভুলে যাই।]
No comments:
Post a Comment