Thursday, November 25, 2010

স্মৃতির শহরঃ দুই পৃথিবী

ধুদ ১টা ৩/-
মুরঘি ১টা ১৫/-
আঠা ১ সের...

আম্মা চোখ কুঁচকে আলোর লেখা বাজারের হিসাব পড়তে থাকেন। উর্ধ্বগামী খরচের চেয়ে বানান ভুলের প্রাবল্যই হয়ত তাঁকে বিচলিত করে বেশি। যেকোন ভুল বানান সংশোধন করাটা তাঁর প্রায় স্বভাবের অন্তর্গত হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভা, ইংরেজী, বাংলা, অঙ্ক, ভূগোল, সাহিত্য সব বিষয়েই তাঁর পান্ডিত্য ছিল অগাধ, একাধিক বিদেশি ডিগ্রি কুক্ষিগত করেছেন অনায়াস দক্ষতায় তবুও তাঁকে দিনের শেষে বাজারের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হয়, সংসারের অর্থনীতি চিন্তায় দিনাতিপাত করতে হয় অহর্নিশ। এই পার্থিব সংসারের চাপে অচিন পাখির মতই উচ্চাশাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে তাঁর।

আমি সকালে ঘুম ঘুম চোখে দেখি তিনি অফিসে যাবার জন্য প্রস্তুত। দুপুরে অফিস থেকে ফিরে প্রিয় কোন বই হাতে একটু বিশ্রাম, রাতে আমাদের পড়াশুনার তদারকি আর সংসারের যাবতীয় একাউন্টিং। দামি কোন কিছু কিনতে গেলেই পিছিয়ে এসেছেন, বেশিদিন আর বাঁচবো না, পয়সা নষ্ট করে কি হবে? নশ্বরতায় এই চিন্তায় চিন্তায় কিছুই ঠিক আর কিনে ওঠা হয় নি, দেখতে দেখতে পুরানো আসবাব-পত্রে বাসা হয়ে গিয়েছে মিউজিয়াম। বেড়ানো অথবা ভ্যাকেশন? অফিসের ট্যুর ছাড়া কখন দেখিনি তাঁকে শহরের চৌহদ্দি পার হতে। এভাবেই অর্থমন্ত্রীত্ব করতে করতে কেটে গেছে প্রায় পুরোটা জীবন।

আমার বাবার বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল, যদিও উনার সাধুভাষায় লিখিত গদ্য ছিল অতি প্রাঞ্জল। ফোনে আমাদের বাসার আসার নির্দেশনা দিতে গেলে আব্বা প্রায়ই বলতেন...

“জ্বি জ্বি...আমাদের বাসাটা তেঁজগা স্টেশনের একদম উপরেই... হাড়ভাঙার দোকানের পেছনেই...”

আব্বার এই “ডিরেকশন” শুনে আম্মার বিরক্তি বেশ চরমে উঠত। স্টেশনের উপরে কিভাবে মানুষের বাসা হয়? হাড়ভাঙার দোকান কি প্যারিসের আইফেল টাওয়ার যে সবাই চিনে ফেলবে? যেহেতু আব্বা খুব গুছিয়ে কোন কিছু ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, তাই আমাদের বাসার পররাষ্ট্র ও গণযোগাযোগ দফতরও আমার মায়ের দখলে। কিন্তু আমরা কেউ অসুখে পড়লে এইসব মন্ত্রীত্ব বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদে হঠাৎ মায়ের আবির্ভাব, চিকেন স্যুপ, পোলাওয়ের চালের নরম ভাত, অল্প মসলা দেওয়া ঝোল....যদিও আমার খেতে ইচ্ছে করত না তখন...কিন্তু শাস্ত্রে নাকি আছে ফিড আ কোল্ড এন্ড স্টার্ভ আ ফিভার...আমি ভাবতাম আমারতো জ্বর, তাহলেতো না খেয়ে থাকার কথা, কিন্তু কেন জানি আমার অসুখটা সব সময়ই “কোল্ডই” হতো, তাই জোর করেই খেতে হতো। তাছাড়া জীবাণুর সাথে যুদ্ধ করতে গেলে শরীরে বল লাগবে না? এখন নিজের বুদ্ধিতেই অসুস্থ শরীরে খাবার গলঃধরণ করি কিন্তু জ্বরের ঘোরে যেন সেই অমৃতই খুঁজে বেড়াই।

আম্মার একমাত্র বিলাসিতা ছিল বই পড়া। দুপুরে বা রাতে বই না পড়লে ঘুমই আসতে চাইতো না। প্রায়ই আম্মা আমাদের গল্প অনুবাদ করে শোনাতেন, ঘুম ঘুম দুপুরে শার্লক হোমসের গল্প শুনতে শুনতে চোখের সামনে দেখতে পেতাম বেকার স্ট্রিটের বৈঠকখানা আর পরক্ষণেই আমাদের বারান্দার রোদ্দুর আর পুকুরের ধারের নারিকেল গাছের সারি তাকিয়ে আমার মনে হতো ইংল্যান্ডের চেয়ে ঢের ভালো আমাদের এই তেজগাঁ, কী সুন্দর এবং শান্তিময়, একটা জীবন অনায়াসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় আমাদের এই ২৯ নম্বর বাসভবনে। বহু বহু বছর পরে বেকার স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে কেন জানি সেই দুপুর বেলার গল্পই ফিরে এসেছিল, শার্লক হোমস নন, মায়ের মুখে শোনা অসাধারণ গল্প গুলোই ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিল যাবতীয় সাধারণ কথামালা। শুধু অনুবাদ নয়, আম্মা নিজেও প্রচুর গল্প তৈরি করতেন, কোন কোন গল্পে তিনি নিজেই নায়িকা, এসেছেন পরীদের দেশ থেকে, কাজ শেষ হলে চলে যাবেন আবারো সেই মুলুকে, তাঁর পায়ের নিচের গোলাপি রঙ কালচে হয়ে যাচ্ছে আমাদের এই ইঁট-পাথরের ময়লা দুনিয়াতে এসে। এই প্রামাণ্য দলিল দেখে বিষাদগ্রস্ত হয়েছিল মন শৈশবে, অর্ধেক জীবন শেষ করে সেই বিষাদ আজো ডানা মেলে, বেড়েই চলেছে যে সেই মালিন্য আমাদের এই দুষ্ট পৃথিবীতে এসে।

শৈশবে আমার ছিল ব্যাপক ভূতের ভয়। রাতে বাসায় জ্বলত অনুজ্জ্বল হলুদ রঙের ৪০ পাওয়ারের বাতি, তাতে মনে হয় আলোর চেয়ে অন্ধকারটাই জোরদার হতো বেশি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যেত একটু দূরের গীর্জার সাথে লাগোয়া কবরস্থানের টিমটিমে বাতি। অনেক পুরানো সেই কবরগুলো, ভূত হওয়ার জন্য অনেক সময় পেয়েছেন উনারা। এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম যে তেনারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন পাড়াময়...রাতে বাথরুমের বন্ধ কল দিয়ে যে টিপটিপ করে পানি পড়ে তাতেও উনাদের হাত আছে নিশ্চয়। রাতে আমি ভয়ার্ত গলায় আম্মাকে জিজ্ঞেস করলে উনি অভয় দিতেন ওইগুলো নাকি ছোটখাটো ভূত...ভদ্র স্বভাব...কারো কোন ক্ষতি করে না।

ভূত বলে কিছু নেই এটা কেন বলেলনি -- এই প্রশ্নের উত্তর নেই, তবে ওইসব নিরীহ ভূতগুলো আসলেই কোন ক্ষতি করত না, শুধু শৈশবকে একটু বর্ণাঢ্য করার বিনোদনমূলক দায়িত্ব ছিল ওদের। আমরা ফ্ল্যাট-ট্যাট তৈরি করে তাড়িয়ে দিয়েছি ওদেরকে, আজকের এই শহরে মানুষ ধারণ করাই কঠিন, ভূততো দূরের কথা।

আমি ওই পৃথিবী ছেড়ে এসেছি অনেকদিন। যেই পৃথিবীতে এখন আমার বাস, সেটা কল্পনা থেকে দূরে, পরীদের থেকে দূরে, দুপুর বেলা শোনা গল্প থেকে দূরে, জ্বরের ঘোরে ভাত খাবার অনিচ্ছা থেকে দূরে, ভালো ভালো সব ভূতদের থেকে দূরে, সন্ধ্যার মুখে তেজগাঁর বাসার ছাদে বসে রেলের শব্দ আর পাখিদের ঘরে ফেরা থেকে দূরে, কামরাঙা গাছে বসা টিয়ে পাখির থেকে দূরে, আমার পোষা কুকুর “জো” এর থেকে দূরে, যেই জগতে আমার বেড়ে ওঠা, যেই জগতটা আমার একান্তই নিজের ছিল, সেই শৈশব থেকে বহু বহু দূরের এক পৃথিবীতে আমার বাস।

এখানে কল্পনা নেই বরং আছে ঘোরতর বাস্তব, পরীদের আনাগোনা নেই, নেই গল্প শোনার দুপুর, আছে বোকাবাক্সের বোকা বোকা গল্পকথা। বিনোদিত করার মত ভূত নেই বরং আছে বিকট সব হরর ফিল্ম, নেই শেষ রাতের রেলগাড়ির শব্দ, নেই সবুজ রঙের গাছে আরো সবুজ পাখি, বরং আছে দাঁড়বন্দি ডানার কষ্টময় ঝাপটানি। আর নেই আমার সেই বিস্ময়কর জগতের সূত্রধর, আমার মা। কর্কট রোগসহ নানান ব্যধি তাঁকে জর্জরিত করেছে, আর বিমর্ষ ও ব্যথিত করেছে আমাকে।

আজ আমরা দুই পৃথিবীর বাসিন্দা, ভৌগলিক দূরত্বের বাইরেও এই দুই জগতের দূরত্ব যেন প্রায় অনতিক্রম্য। এখান থেকে সেই জগতে ফেরাটা অসম্ভব। সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে শুধুই স্মৃতির শহর, বিনা টিকেটে, বিনা খরচে, বিনা বাধায় সেই জগতে প্রবেশ করা যায়, এইটুকু আছে বলেই আমার সেই পৃথিবীটা এখনো হারিয়ে যায়নি। স্মৃতির শহর আছে বলেই বর্তমান পৃথিবীটাকে এখনও মায়াময় লাগে।

বেঁচে থাকুক আমার এক ফোঁটা স্মৃতির শহর!

খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে,
স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে।
এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,
চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর।
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের,
আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর।
পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল,
প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল।
তারা ঝিকিমিকি পথ ঘুমের দেশের,
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের।

(রূপকথা – আহসান হাবীব)

###

No comments: