বইপড়ার অভ্যেসটা আমার বেশ অল্প বয়েসেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে টেলিভিশনের তখন একটাই চ্যানেল, তার সাথে যুদ্ধ করে বিনোদন মাধ্যম হিসেবে বইয়ের টিঁকে থাকা বেশ ভালোই সম্ভব ছিল। বন্ধুদের অনেকেই প্রচুর বই পড়ত, আমাদের বাসাতেও অনেক ধরণের বই ও পত্রিকা আসত। আমি আনন্দমেলা পড়তাম নিয়মিত, বাংলাদেশে ছোটদের পত্রিকা বলতে ছিল “কিশোর বাংলা” আর “ধানশালিকের দেশে”। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের “দীপু নম্বর টু” মনে হয় কিশোর বাংলাতেই বেরিয়েছিল। কিশোর সাহিত্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গের উপরই বেশি নির্ভর ছিলাম, সুনীল, শীর্ষেন্দু সহ প্রায় সব নামজাদা লেখকই নিয়মিত লিখে চলেছেন কিশোর সাহিত্য। ফেলুদা সহ সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য বইও বের হচ্ছে হরহামেশা। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যয়ের টেনিদা অনেক পুরানো হলেও সেটার আবেদন ফুরায় নি, সত্যি বলতে কী টেনিদার গল্প পড়তে আমার এখনো দারুণ লাগে।
আমাদের বাসায় দেব সাহিত্য কুটিরের পূজা সংখ্যার স্তুপ ছিল, সবচেয়ে পুরানো সংখ্যাটার নাম ছিল রাঙারাখি যেটা বের হয়েছিল ৪০ এর দশকে, আর সবচেয়ে নতুনটার নাম ছিল ইন্দ্রনীল, সম্ভবত ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বের হওয়া। দেব সাহিত্য কুটির মনে হয় আনন্দ পাবলিশার্সেরও আগের আমলের, ওদের পূজা সংখ্যাগুলো ঝকঝকে অফসেটে ছাপা হত, হার্ড কভারের মলাট আর দারুণ বাঁধাই ছিল বইগুলোর। দেব সাহিত্য কুটিরের অস্তিত্বও মনে হয় নেই আর আজকে।
আম্মার কাছে শুনেছিলাম যে ত্রিশের ও চল্লিশের দশকে শিশু কিশোরদের জন্য অনেকগুলো পত্রিকাই বের হত, রংমশাল, মৌচাক, শিশুসাথী, শিশু সওগাত। আমি সেগুলো চোখেও দেখিনি। আনন্দ পাবলিশার্স “সেরা সন্দেশ” বের করাতে সেগুলোও কিছু পড়া হয়েছে, যদিও সন্দেশ মনে হয় ষাটের দশকের পত্রিকা। দুঃখজনক হলো সে তুলনায় আমার শৈশবে অনেক কম পত্রিকা ছিল বাচ্চাদের জন্য। এখনকার অবস্থা হয়ত আরও করুণ। তবে সেই সময় কোন দুঃখ ছিল না, বাসা থেকে হাঁটা পথ দূরে খালার বাসার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে পনের হাজারের বেশি বই ছিল। আমার ডুব দেওয়ার মত প্রচুর রসদ ছিল সেখানে। বই পড়ে পড়ে আমার মনটা বেশ কল্পনাপ্রবণ হয়ে গিয়েছিল, দৈনন্দিন জীবনের বাইরের একটা জগত ছিল একদম আমার নিজস্ব।
বইয়ের পাশাপাশি ছেলেবেলায় অভ্যেস ছিল উদ্দেশ্যহীন হাঁটারও। একেকদিন হাঁটা দিতাম একেক দিকে, কোন গন্তব্যে নয়। ঢাকা শহরটাও তখন এলোমেলো হাঁটার জন্য মন্দ ছিল না। বিকেল বেরিয়ে সন্ধ্যের একটু আগে বাসায় পৌঁছাতে পারলেই কোন ঝামেলা নেই। আমি হেঁটে তেঁজগা স্টেশনে যেতাম, প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকতাম। মাঝে মাঝে রেললাইনের নুড়ি পাথরে ছোট একটা লাথি দিয়ে দেখতাম কতদূর নিতে পারি। তখন ঢাকায় ফাইভ স্টার হোটেল যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি বাড়ছে ছিন্নমূল মানুষের ভিড়। রেললাইনের পাশে গড়ে উঠছে বস্তি, ঢাকা আস্তে আস্তে মেগাসিটি হতে চাইছে। আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, মাথার মাঝে সদ্য পড়া ভ্রমণ কাহিনী, চারপাশের জমে ওঠা দুঃখ-কষ্ট আর আবর্জনা আমাকে স্পর্শ করে না। আমি ভাবছি আনন্দমেলাতে পড়া মানস সরোবরে ভ্রমণ কাহিনী, এই উত্তর দিকেই তো সেটা। এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এই শহরের কোলাহলগুলো পেরিয়ে, জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর পার হয়ে ইন্ডিয়া আর ভূটান পার হলে তিব্বতে পৌঁছানো যেতে পারে। আমি হাঁটছি আর মাথা ভেতর ছবি আঁকছি দূরের কোন দেশে পাহাড়ের মাঝে শুয়ে আছে এক বিশাল হ্রদ। ভূগোলের অসম্ভবতাকে পরাজিত করে আমার কল্পনার সেই সরোবরের পাশেই আছে প্যাগোডার মত মন্দির, আর তার পেছনেই চির হরিৎ গাছের সারি, গেরুয়া পরা সন্ন্যাসী আর নাম না জানা সব ফুলের সমারোহ। সেই হ্রদের জলে কি রাজহাঁস সাঁতার কাটে? মনে হয় না, ঠান্ডায় তো সব জমে বরফ হয়ে থাকার কথা।
হাঁটতে হাঁটতে নাখালপাড়ার রেলক্রসিংয়ে পৌঁছে মনে হয়, এইবার ফেরা উচিত। হোমওয়ার্কের কাজ অনেকটাই বাকি। প্রায় প্রতিদিনই স্কুলে এরজন্য নানান হেনেস্তা হতে হয়। আমি তখনো ঢাকা শহরের বাইরেই বেশি যাই নি, মধ্যবিত্ত পরিবারে ভ্রমনটা প্রায় বিলাসিতাই। কিন্তু ফেরার পথে হয়ত অন্য কোন দেশে ভ্রমণ হয়ে যায়। এভাবে আমি হেঁটে হেঁটে আমি আল্পসের আশেপাশে গিয়েছি, মিশরের পিরামিড দেখেছি, টেমস নদী দেখেছি, আমেরিকার রকি পর্বত পর্যন্ত দেখেছি। তেঁজগা থেকে রমনা পার্ক, সংসদ ভবন, নাবিস্কো আর নাখাল পাড়ার সীমাবদ্ধতায়ও যে পুরো পৃথিবী ঘোরা যায়, সেটা সেই সদূর শৈশবেই জানা হয়ে গেছে।
ঠিক করা ছিল বড় হয়েই ঘুরতে বের হব, যতটা পারব ঘুরে দেখবে এই পৃথিবী। জীবনের লক্ষ্যের কাছাকাছি না হলেও আমি যখনই পেরেছি তখনই মোটামুটি চরে বেড়িয়েছি। কিন্তু কোন ভ্রমণই শৈশবের সেই ভ্রমণকে অতিক্রম করতে পারেনি। কল্পনার রথে চড়ে যে যাত্রা তাকে জেট প্লেন, রেন্ট-এ-কার, ট্রেন বা বাস কীভাবে হার মানায়? এই যে প্রতিদিন সকালে গান শুনতে শুনতে অফিসে আসার সময় ঢু মেরে আসি নয়াটোলা বা পলাশী, সেটা আমার মনের সেই রকেটের মত দ্রুতগতির গাড়িটা না থাকলে কীভাবে পারতাম? শৈশবের পড়া বইগুলোকে ধন্যবাদ, এই গাড়ির কারিগর মনে হয় ওরাই। এই রথে চড়ে আজ আর দুনিয়া চষে বেড়াই না, বরং টুক করে ঢুকে যাই অনেক দূরে পড়ে থাকা এক অভিমানী শহরে। ওখানে মায়ের হাতে সন্তান খুন হয়না, সপরিবারে কেউ আত্মহনন করেনা, রাস্তায় পিটিয়ে মানুষ মারা হয় না, মলম পার্টি কারো জীবন কেড়ে নেয় না, ওখানে এখনো ভালোবাসা হারিয়ে যায় নি, গাছের ডালে পাখিরা ঠিকই ডাকাডাকি করে, ভোরের কুয়াশা ঢেলে রোদের আলো পৌঁছে যায় সবার বাসায় বাসায়। ফেরিওয়ালার হাঁকডাক, রেলগাড়ির শব্দ, রিকশার টুংটাং, ঠ্যালাগাড়ির ক্যাঁচক্যাঁচ যেমন শুনতে পাই ঠিক তেমনি দেখতে পাই হলদে রংয়ের লম্বা বিকেলে খেলার মাঠে বালকদের বল পিটানো।
এখন আমার যাত্রাগুলো যেন শৈশবের দিকেই, বেলা কিংবা অবেলায় কী আশ্চর্য এই ভ্রমণ!!!
No comments:
Post a Comment